আচার্য নরেন্দ্র দেব ও মার্কসবাদ - Pralipta

কৌশিক নন্দী - ভারতবর্ষের ইতিহাস সমাজবাদী আন্দোলনের কথা নিয়ে দুই এক লাইন লিখতে গেলেই লিখতে গেলেই  যে ঋষি তুল্য মানুষের ভাবমূর্তি  চোখের সামনে ভেসে ওঠে যিনি  আজীবন অবিচল নিষ্ঠা সততা আদর্শের জন্য লড়েছেন তিনি হলেন আচার্য নরেন্দ্র দেব। তিনি যদি রাজনীতিবিদ না হতেন তাহলেও শিক্ষাব্রতী হয়েও তার জীবন   কম উজ্জ্বল্য লাভ করত না।বারানসি লখনৌ এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে গঠনমূলক ভূমিকা সাফল্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাই এই  বিদগ্ধ সমাজবাদী চিন্তক-এর দৃষ্টিতে মার্কসবাদ নিয়ে একটু আলোচনা করবো।আচার্য আগাগোড়া নিজেকে মার্কসবাদী বলে দাবি করেছেন কিন্তু ওনার কাছে মার্কসবাদ ছিল না ছকবাঁধা বা  যান্ত্রিক ।তিনি বলেছেন যে মার্কসবাদীরা কখনো গোঁড়া বা  গোষ্ঠীভাবা পণ্য  হতে পারেন না আর সমাজবাদ কোন একটা dogma  নয় এবং শুধুমাত্র মৌলিক রচনার মধ্যে এটা আটকে থাকবে এটা একটা চরম বোকামি। পরিবর্তিত অবস্থা ঐতিহ্য সাথে সাথে পরিবর্তন করতে হবে ।অর্থাৎ revision  তার কাছে অপরাধ নয়।  তিনি যুক্তিবাদী  মানসিকতা র মাধ্যমে তিনি মার্ক্সবাদকে বিশ্লেষণ করেছেন এক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে। মার্কস ও এঞ্জেল বলেছিলেন শ্রমিক শ্রেণীর এর কোনও দেশ নেই। এই ব্যাপারে তাহার যেমন সহমত ছিল তেমনি তার ভিন্নমত ও ছিল অনেক জায়গায়। মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করতেন দেশাত্মবোধ একটা ক্ষীয়মান সেন্টিমেন্ট যে ধর্মের মত ভ্রান্ত চেতনার পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু নরেন্দ্র দেব দ্ব্যর্থহীন ভাবে এই ধারণার সমালোচনা করেছেন । কারণ তিনি নিজে ছিলেন  সক্রিয় স্বাধীনতা সংগ্রামী।  তিনি সমাজতত্ত্বের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের একটা মিলন ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। এবং মার্কসীয় ধারণার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল সমাজবাদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদকে এক তরকারি তে দেওয়া যায়না। তিনি সেখানে প্রশ্ন তুলেছেন এবং দ্বিধাহীনভাবে তিনি ঘোষণা করেছেন একটি পরাধীন জাতির পক্ষে রাজনৈতিক স্বাধীনতা সমাজবাদের পথে একটি অপরিহার্য ধাপ। 1955 সালে psp এর নীতি নির্ধারক ঘোষণার প্রধান রচয়িতা ছিলেন আচার্য্য। এই ঘোষণা গয়া থিসিস নামে পরিচিত ছিল। এই ঘোষণায় তিনি নৈতিকতা সমন্ধে  তার মত ব্যক্ত করেছেন ।সেখানে তার চিন্তাভাবনা মার্কসবাদ কে অতিক্রমন করে গেছে।                তিনি বলেছেন একটা শ্রেণীভিত্তিক সমাজের নৈতিকতা কখনোই সমগ্র সমাজের নৈতিকতার সঙ্গে সমান হতে পারে না।সমাজের সার্বিক তাগিদ টাও মেটাতে পারে না। কিছু নৈতিক মূল্য আছে কিছু নৈতিক মানদণ্ড আছে যা সব শ্রেণীর কাছে গৃহীত হবার দাবী রাখে। যার একটা স্থায়ী মূল্য আছে।  তার মতে কিছু সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা যুক্ত নৈতিক গুন হল সাহস ধৈর্য সত্যনিষ্ঠা সরলতা ও দরদবোধ। সমাজবাদ চাইবে এই নৈতিকতা গুলো প্রত্যেকের মধ্যে যেন গড়ে ওঠে। এগুলো শ্রেণী সমাজের নৈতিকতা বলে বাতিল না করে দেওয়া। মনে হয় তিনি নৈতিকতাকে দুটো ভাগে ভাগ করেছেন একটা শ্রেণীভিত্তিক নৈতিকতা ও সার্বজনীন নৈতিকতা। যেখানে নৈতিকতার প্রশ্নে  মার্কসবাদ একেবারে উদাসীন ।সেখানে  তিনি মনে করেন নৈতিকতার  একটা নিজস্ব শক্তি বিরাজমান একটা সমাজবাদী আন্দোলনের স্বপক্ষে একটি ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে।   নৈতিকতা মূল্যবোধ প্রশ্নে যদি উদাসীন হওয়া যায় তারা কখনো ন্যায়-অন্যায়ের মোকাবিলা করতে পারবেনা।             মার্কসবাদে আরেকটি ধারণা নিয়ে প্রবল সমালোচনা করেছেন তিনি মার্কসবাদীরা মনে করেন সর্বহারাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী কিন্তু তিনি একথা মানতে নারাজ তিনি বলেছেন এ শক্তি কখনোই যথেষ্ট হতে পারেনা যদি এর মধ্যে বৈপ্লবিক ন্যায় বোধ  না থাকে। এই বৈপ্লবিক ন্যায় বোধ  এই সার্বিক অগ্রগতি কি করে আসবে  প্রশ্ন টা কিন্তু থেকেই যায় ।  এটা একমাত্র আসবে  সমষ্টির নৈতিকতা থাকে । যেখানে শুধুমাত্র শ্রেণীভিত্তিক নৈতিকতা কার্যকর হবে না ।তাই মানুষের শক্তি ছাড়া শুধু নৈব্যক্তিক শক্তির চাপে আপনাআপনি সমাজবাদ আসবে না। যদিও তিনি লেনিনের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাবান ছিলেন।  রাশিয়ার পরিবর্তনকে তিনি সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা বিলোপ অপরিকল্পিত অর্থনীতিকে তিনি যথেষ্ট প্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন । তার জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানার চাইতে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ছিল "উৎপাদন ব্যবস্থার সামাজিক মালিকানা"।  কারণ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সাধারণ মানুষের রাষ্ট্রের সামাজিক নীতির উপর কোনো কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। তার মতে সর্ব নিয়ন্ত্রণবাদ বাদী কমিউনিজম হলো গণতন্ত্রের অস্বীকার। এটা মানুষের মর্যাদা ধ্বংস করে এবং ব্যক্তি কে তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে।তিনি বলেছেন একটা টোটালিটারিয়ান দল  কখনই সমাজবাদী দল নয় যদিও তার সামাজিক লক্ষ্য অন্যদের মতো ঘোষিত হতে পারে। কমিউনিজম গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ নয় এবং যেসব মূল্যবোধ মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য সেসবের প্রতি  তাদের শ্রদ্ধা নেই।তিনি আরো বলেছেন আমরা সেই কমিউনিস্ট দলের নেই যারা ব্যক্তি স্বাধীনতা ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর যারা করে পৃথিবী একটি বিরাট সেনাবাহিনীর ব্যারাকে অথবা একটা একটা বিরাট  শ্রম শিবিরে পরিণত করতে চায় । সোভিয়েত রাশিয়ায় লেনিন সর্বহারাদের যে " একনায়কত্ব"   একটা স্বল্পস্থায়ী ব্যাপার এবং বিশেষ কোনো দলের নয় শ্রমিক শ্রেণীর গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র।