Calligraphy art : ইন্দো ইসলামিক স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন তাজমহলের ক্যালিওগ্ৰাফি, জেনে নিন ইতিহাস - Pralipta

কোয়েল সাহা: বিপুলা এ পৃথিবীর বৈচিত্রের অন্ত নেই।বৈচিত্রের বর্ণচ্ছটায় হতচকিত মানুষ আবেগতাড়িত হয়ে বিস্ময়ের বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছে বারবার।মধ্যযুগে বিদ্যমান ছিল পৃথিবীর এমন বিস্ময়কর বহু বস্তু সৃষ্টির আভ্যন্তরীণ কাহিনী আজ আমাদের অবাক করে দেয়।মধ্যযুগের সাতটি আশ্চর্য, মধ্যযুগীয় মন ও মধ্যযুগের স্থাপত্যশিল্পের বিস্ময়।মধ্যযুগের এই সাতটি বিস্ময়ের মধ্যে মুঘল স্থাপত্যশৈলীর একটি আকর্ষণীয় নিদর্শন হল তাজমহল।এই ভগ্নপ্রায় স্থাপত্যের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মুঘল রাজবংশ, শাহজাহানের রাজকাহিনীর অতীত।


ভারতের গৌরবময় অতীতের স্মৃতি এই তাজমহল বানানো হয়েছিল প্রধানত ভারতীয়, ফারসি এবং ইসলামিক ভাস্কর্যের সংমিশ্রণের দ্বারা।ইন্দো ইসলামিক স্থাপত্য গুলির মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ স্থাপত্য হল তাজমহল। এর নির্মাণ এতটাই নিখুঁত ও সৌন্দর্যময় যা অনান্য সব স্থাপত্য থেকে এটিকে আলাদা করে। অত্যাশ্চর্য মার্বেল সমাধিটি জটিল স্থাপত্য এবং শৈল্পিক বিবরণ দিয়ে পরিপূর্ণ যা এটিকে স্থাপত্য দক্ষতার একটি প্রতিকৃতি করে তোলে।


ভারতের আগ্রার যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত , তাজমহল আধা-মূল্যবান পাথর, ফুলের আঁকা, মোটিফ এবং ক্যালিগ্রাফি দিয়ে সাজানো সাদা মার্বেলের অপরূপ কাঠামো আজও পর্যটকদের হাতছানি দেয়।


তাজমহলের নকশা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তাজমহলের স্থাপত্যের অপরূপ কারুকার্য দেখলে বোঝা যায় যে সেইযুগেও ক্যালিগ্রাফির বিশেষ গুরুত্ব ছিল।ক্যালিওগ্ৰাফি?? হ্যাঁ ক্যালিওগ্ৰাফি ,ভুল শোনেননি।ভাবতেও অবাক লাগে যে ক্যালিওগ্ৰাফির ডিজাইনে মুগ্ধ গোটা পৃথিবী, সেই ক্যালিওগ্ৰাফি ছোঁয়ায় আরো প্রানবন্ত হয়ে উঠেছে মুঘল যুগের সম্রাট শাহজাহান আর মুমতাজের ভালবাসার প্রতীক এই স্মৃতিসৌধ।


ইন্দো ইসলামিক স্থাপত্যের গায়ে যে এতো সুক্ষ কারুকাজের সৌন্দর্য আঁকা আছে তা দূর থেকে বোঝা কঠিন হলেও স্থাপত্যের কাছাকাছি গেলে শ্বেত পাথরের গায়ে লাল চুনি, সবুজ পান্না, হলুদ অ্যাম্বার দিয়ে অাঁকা লতা পাতার নকশা এবং তার সাথে কালো জেড পাথর দিয়ে আঁকা চমৎকার ক্যালিগ্ৰাফির নকশাতে আপনার চোখ যে ধাঁধিয়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

তাজের প্রধান গম্বুজে ঢোকার মুখে সেই অপূর্ব ক্যালিগ্রাফি দেখা যায়।সতেরো শতাব্দীর ঐ ক্যালিগ্রাফিগুলোর সূক্ষ নকশা দেখে বোঝাই যায়, সাদা পাথর খোদাই করে করে কালো পাথরের নক্সা ফুটিয়ে তুলতে কি অসম্ভব পরিমাণ সময়, ধৈর্য, পরিশ্রম, পটুত্ব ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন হয়েছিল। এ যেন এক শিল্পের জগত। একবার এই অপূর্ব সৃষ্টির গায়ে একবার হাত ছুঁয়ে দেখলে এ জন্ম বুঝি সার্থক এমন মন্তব্য করেছেন অনেক পর্যটক। কিন্তু এই অপূর্ব ক্যালোগ্ৰাফির নকশার আসল দাবিদার কে? কে এই সুন্দরের প্রতীককে আরও নিপুণ রূপ দিয়েছিল তাঁর ধৈর্য, পরিশ্রম দিয়ে?

তাজের গায়ে ঐ সুক্ষ কারুকাজের জন্যে যার নাম উঠে আসে তিনি হলেন আবাদ-আল-হক, তিনি ভারতের বাসিন্দা ধন তিনি সুদূর ইরান থেকে শাহজাহানের দরবারে এসেছিলেন, এবং তিনি এক দক্ষ ক্যালিওগ্রাফার ছিলেন। সুদূর ইরানে জন্মেছিলেন আবাদ-আল- হক সেখানেই বেড়ে ওঠা তাঁর। সেখান থেকে শুরু হয় তার গৌরবময় জীবনের যাত্রা… 

ছোটো বয়স থেকেই ক্যালিগ্রাফির কাজ নিয়ে তাঁর ওঠাবসা। হাতের নিপুণ টানে ক্রমশ জীবন্ত হয়ে ওঠে অক্ষরগুলো; সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর কাজে ফুটে ওঠে সৌন্দর্যের মাধুর্য্য। বড়ো দাদা আফজল খান, ভাইয়ের এই ক্ষমতা দেখে মনস্থির করেন তিনি তার ভাইয়ের প্রতিভাকে নষ্ট হতে দেবেন না। তাই যখন ভারতে মুঘল রাজদরবারের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন, তখন সঙ্গে নিলেন ভাই আবদ-আল হককেও। দুজনে মিলে সতেরশো শতকের শুরুর দিকে এলেন আগ্রা। মসনদে তখন সম্রাট শাহজাহান।আবাদ - আল- হকের অসাধারণ প্রতিভা তাকে মুঘল দরবারে স্বীকৃতি এনে দেয়। ফলস্বরূপ, সিকান্দারাতে সম্রাট আকবরের সমাধির প্রবেশপথে কোরানিক আয়াত এবং আগ্রার শাহী মাদ্রাসার মতো বেশ কয়েকটি মুঘল স্মৃতিস্তম্ভে তাঁর কাজ প্রদর্শিত হয়।মুমতাজ বেগমের সঙ্গে সম্রাটের বিবাহিত জীবন ছিল ১৯ বছরের। অথচ মাত্র ১৯ বছরের বিবাহিত জীবনে মুমতাজ শাহজাহানের ১৪টি সন্তান প্রসব করেন। বলাবাহুল্য এই কারমেই তিনি ছিলেন শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল। শারীরিক ধকল সহ্য করতে না পেরে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে বুরহানপুরে (বর্তমান মধ্যপ্রদেশ)সন্তান প্রসব করতে গিয়ে প্রাণ হারান শাহজাহানের প্রিয়তমা পত্নী মুমতাজ বেগম।শোকাহত সম্রাট তার মৃত্যুতে তার বেদনা ও যন্ত্রণাকে চিরতরে চিহ্নিত করার জন্য একটি বিশাল সমাধি নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।


তখন সেই সময় শাহাজাহানের চোখে পড়ল ক্যালিওগ্ৰাফার আবাদ-উল-হককে,সেই সময়ে আবদ-আল হকের থেকে ভালো ক্যালিগ্রাফার আর কেউ নেই।সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে ১৬৩২ থেকে ১৬৩৮— প্রায় ছয় বছর ধরে নিজের তুলির টানে ভরিয়ে দিলেন তাজমহলের দেওয়াল। মুসলিম ধর্ম গ্রন্থ পবিত্র কোরানের অক্ষর গাথায় ভরে গেল সৌধের দেওয়াল। শিল্পীর অসাধারণ দক্ষতা ফুটে উঠল লেখনীর প্রতিটা অক্ষরে।কোরান থেকে বিশেষ ঐ বানী গুলো আবাদ - উল - হক নিজে তাজের চত্বরকে সাজানোর জন্যে বেছে নিয়েছিলেন। শাহজাহান তাঁর কাজে মুগ্ধ হয়ে নাম দিয়েছিলেন ‘আমানত খান’।ক্যালিগ্রাফার আমানত খান কোরানের পাঠ্যটি এমনভাবে ডিজাইন করেছিলেন যাতে সমস্ত অক্ষর একটি অভিন্ন আকারের সাথে দর্শকের দিকে ফিরে যায়। এই প্রভাব তৈরি করার জন্য তাকে সর্বোচ্চ চিহ্নগুলিকে বড় করতে হয়েছিল।এমন একটি কৌশল যার জন্য দৃষ্টিভঙ্গির একটি দুর্দান্ত দক্ষতার প্রয়োজন।


তাজমহলের দেওয়াল ছাড়াও মুমতাজ মহল এবং সম্রাট শাহজাহানের সমাধিতে এইরূপ শ্লোকগুলি খোদাই করা হয়েছিল। তাজমহলের বিভিন্ন স্থানে ক্যালিগ্রাফি শিলালিপি হিসেবে আল্লাহ-র ৯৯টি ভিন্ন নাম খোদাই করা রয়েছে।


তাজমহলের স্মৃতিস্তম্ভে যে পাঠ্যগুলি খোদাই করা আছে তা কুরআন থেকে নেওয়া লাইন এবং আয়াত। যে সূরাগুলো উদ্ধৃত করা হয়েছে সেগুলো হলো 
সূরা ৯১ (সূর্য)
সূরা ১১২ (বিশ্বাসের বিশুদ্ধতা)
সূরা ৮৯ (প্রভাত)
সূরা ৯৩ (মর্নিং লাইট)
সূরা ৯১ (ডুমুর)
সূরা ৯৪ (সান্ত্বনা)
সূরা ৩৬ (ইয়া সিন)
সূরা ৮১ (ভাঁজ করা)
সূরা ৮২ (দ্য ক্লেভিং আসুন্ডার ) )
সূরা ৮৪ (দ্যা রেন্ডিং আসুন্ডার)
সূরা ৯৮ (প্রমাণ)
সূরা ৬৭ ( আধিপত্য)
সূরা ৪৮ (বিজয়)
সূরা ৭৭ (যারা পাঠানো হয়েছে)
সূরা ৩৯ (জনতা)

সমাধি কক্ষে অবস্থিত মমতাজ মহলের প্রকৃত সমাধিতে, "হে মহান, হে মহৎ, হে অনন্য, হে চিরন্তন, হে মহিমান্বিত... "এবং শাহজাহানের সমাধিতে একটি ক্যালিগ্রাফিক শিলালিপি রয়েছে যাতে লেখা রয়েছে "তিনি ১০৭৬ হিজরিতে রজব মাসের ২৬ তারিখ রাতে এই পৃথিবী থেকে অনন্তকালের ব্যাঙ্কোয়েট হলের দিকে যাত্রা করেছিলেন"।


তাজমহল শুধু এক চলে যাওয়া সময়ের প্রাচীন স্থাপত্য নয়, এই মহিমান্বিত স্মৃতিস্তম্ভটি প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রেমের গল্পের প্রতীক। এই অপূর্ব সৃষ্টির গায়ে একবার হাত ছুঁয়ে দেখলে এ জন্ম বুঝি সার্থক এমন মন্তব্য করেছেন অনেক পর্যটক।মুঘল সাম্রাজ্য ভারতীয় সংস্কৃতি, স্থাপত্য এবং ইতিহাসের বুননে তার চিহ্ন রেখে গেছে।

তথ্যসূত্র ও ছবি : ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত