Murshidabad Muharram: মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্যবাহী মহরমের সেকাল ও একাল - Pralipta

ফারুক আব্দুল্লাহ: ১৪০০ বছর আগে আরব দেশের কারবালা প্রান্তরে হজরত মহম্মদ (সাঃ) এর নাতি ইমাম হোসেনকে হঠাৎই এক অসম লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হয়। মরুপ্রান্তরে অবরুদ্ধ অবস্থায় তৃষ্ণায় কাতর হয়ে বেশ কয়েকজন শিশু ও মহিলাসহ সপরিবারে সপার্ষদে তিনি শত্রুদের হাতে নির্মম ভাবে প্রাণ হারান। সেই দিনটি ছিল হিজরি মহরম মাসের ১০ তারিখ। মুসলিম সম্প্রদায় প্রতি বছর এই তারিখে মহরম পালনের মধ্যে দিয়ে সেদিনের ওই নির্মম ও হৃদয়বিদারক ঘটনাকে স্মরণ করে। মহরম কোন উৎসব নয়। এই দিনে কারবালা প্রান্তের সেই নৃশংস ঘটনাকে স্মরণ করে শোক পালনের দিন। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ মানুষই মহরমকে মুসলিমদের উৎসব ভেবে ভুল করে থাকে।

পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের মতো মুর্শিদাবাদেও প্রতিবছর মহরম পালিত হয়ে আসছে সেই নবাবী আমল থেকেই। মুর্শিদাবাদের নবাবরা ছিলেন হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তথা ইমাম হোসেনের বংশধর। ফলে বাংলার নবাবদের কাছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিমদের চেয়ে মহরম ছিল অধিক শোকের। ফলে মুর্শিদাবাদে মহরমের শোক পালিত হত নবাবী পৃষ্ঠপোষকতায়। মহরম উপলক্ষে নিজামত পরিবারসহ মুর্শিদাবাদের শিয়া মুসলিম সম্প্রদায় প্রায় দুইমাস ব্যাপী শোক পালন করত। এই দুই মাসের প্রথম ৪০ দিন পূর্ণ হলে সেই দিনটিকে বলা হত ‘চল্লিশা’ এভাবে ৫০ দিনে ‘পঞ্চাশা’ ও ৬০ দিন পূর্ণ হলে বলা হত ‘ষাটা’ এর পর তাজিয়াসহ নকল শবযাত্রা বের হত এবং শহর পরিক্রমা করে লালবাগের কারবালা পর্যন্ত যেত।মহরম উপলক্ষে হাজারদুয়ারি সংলগ্ন ইমামবাড়া খুলে দেওয়া হত সবার জন্য। নবাবী আমলে এ সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রচুর মানুষের আগমন ঘটতো মুর্শিদাবাদের মহরমে যোগ দেওয়ার জন্য। মহরমে আগত অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা হত ইমামবাড়াতে। এবং সব অতিথিদের জন্য খোলা হতো ‘লঙ্গর খানা’ যেখানে বিনামূল্যে পরিবেশিত হত ‘শাহী নবাবী খাবার’।
মহরম উপলক্ষে শিয়া মুসলিমরা দুইমাস ধরে শোক পালন করতো এবং এই সময় তারা সমস্ত রকমের বিলাসিতা থেকে দূরে থাকত। এই দুইমাস তারা সমস্ত ধরনের আমিষ খাবার খাওয়া থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখত। এবং শোকের প্রতীক হিসেবে এই দুই মাস নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কালো বস্ত্র পরিধান করত। তারা প্রচুর প্রার্থনা ও উপবাসের মধ্যে দিয়ে এই দিনগুলি কাটাত। এই সময় প্রচুর দুঃস্থ, দরিদ্রদের দান করা হত। বাড়িতে বাড়িতে বিভিন্ন ধরণের হালুয়া, চালের রুটি তৈরির পাশাপাশি গরীব-দুঃখী মানুষদের মধ্যে বিতরণের জন্য রান্না হত পোলাও, বিরিয়ানির মতো শাহী খাবারও। সাধারণ দরিদ্র মানুষদের সেগুলি পরিবেশন করা হত, এবং এইসব শাহী খাবার খেয়ে দরিদ্র মানুষগুলি খাবার দানকারীর ইহোকাল ও পরকালের মঙ্গল কামনা করত।

হিজরি মহরম মাসেই ইমাম হোসেনকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তার কষ্টের কিছুটা অনুভব করার জন্য মহরমের সময় সময় শিয়া মুসলিমরা বিভিন্ন মাতাম বা শোক পালন করত। এই মাতম বা শোক বিভিন্ন রকমের হত যেমন ‘আগুন-মাতম্‌’ বা উত্তপ্ত কাঠকয়লার আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে চলা। ‘জঞ্জির (লোহার শিকল) -মাতম্‌’ বা শিকলের সামনে-পিছনে ছোরা বেঁধে নিজের শরীরে আঘাত করে রক্তপাত ঘটানো।

এছাড়া ‘হাত-মাতম্‌’ বা বুক চাপড়ানো। এছাড়াও এর সাথে গাওয়া হত মার্শিয়া গীত বা শোক সংগীত। প্রতি বছর মহরম মাসে এইভাবেই শোক পালিত হত। ১০ই মহরম মুর্শিদাবাদের কারবালা প্রান্তে শুরু হয় প্রকৃত মাতাম। এই দিনে সবাই সাদা পোষাক পরে উপস্থিত হত এবং মাতম শুরু করত।লোহার শিকলের মাথায় ছোরা বেঁধে অথবা হাতে ছোট ছোরা নিয়ে নিজের শরীরে ক্রমাগত আঘাত করত এবং মুখে উচ্চারিত হত ‘হায় হোসেন’ সূর। এভাবেই একটা সময় মাতম পালনকারীদের সাদা কাপড় নিজ রক্তে ভিজে লাল হয়ে উঠত। এবং সেই সময় মাতমকারিদের রক্তাক্ত শরীরে ঢালা হত গোলাপজল। গোলাপজল ও রক্তের গন্ধ বাতাসে মিশে সমগ্র পরিবেশ বিষণ্ণ হয়ে উঠত।

বর্তমানে মহরম উপলক্ষে লালবাগ-সহ মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকার মুসলিম মহল্লাগুলি নতুন সাজে সেজে ওঠে। রঙিন কাগজ ও রঙিন আলো দিয়ে বাড়ী সাজানো হয়। সমগ্র মুর্শিদাবাদ জেলার মুসলিম সম্প্রদায় এইদিন রোজা রাখে অন্তরের পবিত্রতা অর্জনের জন্য, এছাড়া গোটা জেলা জুড়েই লাঠি খেলার প্রদর্শনী চলতে থাকে। সেই সাথে মুর্শিদাবাদ শহরে হাজারদুয়ারী চত্বরে আজও নবাবদের বংশধরসহ শহরের অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ও মহরমে অংশগ্রহণ করে। আজও মহরম পালনে আগত দেশ-বিদেশের অতিথিদের থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা হয় ইমামবাড়াতে। হাজারদুয়ারী সংলগ্ন মাঠে পালিত হয় ‘আগ মাতম্’ বা ইমামবাড়ার ভেতরে মার্শিয়া গীত সহযোগে পালিত হয় 'হাত মাতম্'। এবং মহরমের দিনে আজও মুর্শিদাবাদের কারবালা প্রান্তরে পালিত হয় খঞ্জর মাতম। মাতম পালনকারীর শরীর ছোরা এবং ব্লেডের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্তের ধারা প্রবাহিত হয় যা দেখে ১৪০০ বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনা পুনরায় জাগ্রত হয়ে ওঠে শোক পালনকারীর মনে।

মহরম একটি শোক পালনের দিন হলেও মুর্শিদাবাদে বর্তমানে সেটি একটি উৎসবের রূপ নিয়েছে। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে দেশ-বিদেশের বহু মানুষ তাতে সামিল হয়ে মহরমকে মহতী করে তোলে।

... 
 তথ্যসূত্র :

১) বিচিত্র মুর্শিদাবাদ-এম.বেগম

২) MAJOR,J.H TULL WALSH,A HISTORY OF MURSHIDABAD DISTRICTS (BENGAL) WITH BIOGRAPHIES OF SOME ITS NOTED FAMILIES, LONDON, JARROLD & SONS 10&11 WARWICK LANE, E.C, 1902

... 
Special Thanks To - 

Syed Reja Ali Meerza. 
Syed Athar Ali. 
Syed Asif Abbas Meerza.