Feature: ফিরে দেখা ঝুলন যাত্রা - Pralipta


গৌরব সরকার :

"আজি জাগিয়া উঠিয়া পরাণ আমার

বসিয়া আছে

বুকের কাছে।

থাকিয়া থাকিয়া উঠিছে কাঁপিয়া,

ধরিছে আমার বক্ষঃ চাপিয়া,

নিঠুর নিবিড় বন্ধনসুখে

হৃদয় নাচে,

ত্রাসে উল্লাসে পরাণ আমার

ব্যাকুলিয়াছে

বুকের কাছে!....দে দোল্ দোল্"...(কবিতা ঝুলন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

'ঝুলন' মানেই কী রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমের পরিপূর্ণ প্রকাশের স্মরণীয় তিথি নাকি আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে ঝুলন আনুসঙ্গিকভাবে জড়িত? গোটা পৃথিবী একটা ভয়ঙ্কর অতিমারীর সঙ্গে লড়াই করে চলেছি বিগত দু-বছর ধরে। আমরা ভীত, সন্ত্রস্থ হয়েছি এবং বহু প্রিয়জনকে হারিয়েছি। সংশয়ের ঝুলন দোলায় দিবারাত্রি দুলতে দুলতে আমরা ভয়কে জয় করে আরও বেশি জীবনমুখী হওয়ার প্রতিদিন চেষ্টা করে চলেছি। জীবনের যে জলতরঙ্গ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল তা ধীরে ধীরে মন্দ্র-সোপান পার করে নিত্যনৈমিত্তিকের ঝুলন দোলায়। আমরা ব্যক্তিগত শোক, স্বজন হারানোর ক্ষতিকে সঙ্গ করেই স্বপ্নের দিকে এগিয়ে চলতে চাইছি। আমরা ভুল করি প্রতিদিন, ভবিষ্যতেও হয়তো করব, তবু ভুলের মধ্যেও শিখে নেব উত্তরণের পথ।

বর্তমান সমাজব্যবস্থায় ঝুলন কতটা প্রাসঙ্গিক সে প্রশ্নের সঠিক জবাব হয়তো অল্পকথায় বলে ওঠা সম্ভব নয়। তবে আমরা ছোটোবেলা থেকে যেভাবে 'ঝুলন যাত্রা' পালনের ভঙ্গিমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে এসেছি তাতে দেখেছি সমাজ একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে রাধা কৃষ্ণের আনুষ্ঠানিকভাবে ঝুলনে দোলার পাশাপাশি আমাদের ব্যক্তি চোখে দেখা যে সামাজিক চিত্র তা একত্রিভূত হয়ে ধরা দেয়।

যেমন বন্দুক হাতে সৈনিক ও যুদ্ধ, ওতোপ্রতোভাবে জড়িত যেন। যুদ্ধের দুর্গমতাকে আরও ঘন করে তুলতে পাহাড়ের অবতারণা। আজকের 'ঝুলন'-এ এমন চিত্র কি আমরা সত্যিই চাই? আমাদের ছেলে মেয়েরা 'ঝুলন' বলতে কি যুদ্ধ-যুদ্ধ সাজ চিনবে?নাকি তারা কয়েক ধাপ এগিয়ে বোমা, মিসাইলকে সাজসজ্জার অঙ্গ হিসেবে তুলে ধরতে চাইবে? বিজ্ঞানের বিজ্ঞাপনে বেশি জোর দেবে? নাকি চালু ভাবনা থেকে বেরিয়ে তারা দেখাবে দুর্গম পর্বতারোহী বা শৃঙ্গ জয়ীদের প্রতীকী অবস্থান? আমরা কি জানতে চাইব না নতুন প্রজন্মের কাছে?


সাপুড়ে নয়তো দইওয়ালা এদের দেখা যায় কই?

জলাশয়  বুজিয়ে জঙ্গল কেটে আমরা গড়ে তুলছি ইমারত, ইন্ডাস্ট্রি। কোথায় সাপ? তবু ধরে নেওয়া যেতে পারে এদের গ্রামে-গঞ্জে এখনও দেখা যায়, কখনো শহরেও দেখা যায়। দইওয়ালারা আর ডাকে না পাড়ার অলিতে গলিতে।আর সাপের খেলা দেখার আগেই আমরা জেনে যাই সাপের মুখ থেকে বাঁচার চাল।

লুঙ্গি ও ফতুয়া পরা সবজি বিক্রেতা - ওতো থাকতেই হবে। হাজার শপিং মল বা 'রিটেইল মার্কেট' এসে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিক না কেন আজো আমরা খোলা বাজারে চাষী জেলেদের কাছ থেকে সবজি মাছ কিনি বৈকি। বাজারও থাকবে "ডি ফ্যাক্টো মোনোপলি" নিয়ে গলাও চড়বে আমাদের। দৃশ্যান্তরে উৎপাদক ও বিক্রেতার মধ্যে যতই টানাপোড়েন থাকুক না কেন এখনও এ প্রজন্ম হাট-বাজার দেখতে পাচ্ছে। থাকবে ধান ঝাড়ায় ব্যস্ত কিষান-কিষানিরাও। তবে চাষির বলদ ও লাঙলের জায়গা নিয়েছে আজকের ট্রাক্টর ও সময় বাঁচাতে জিরোটিলেজ।

একটা গোলাকৃতি বা আয়তাকার মাঠ, একফালি ফাঁকা জমি। সত্যি কথা বলতে কি কর্পোরেশন বা মিউনিসিপ্যালিটি কর্তৃক মেইনটেইন্ড না হলে আজকাল ফাঁকফোকর পাওয়া যায় কৈ? খেলার জন্য পাড়ার গলি নয়তো ক্লাব। তবে শহরতলী অথবা দূরে কোথাও বেড়াতে গিয়ে বড় বড় মাঠ দেখলে চোখ আটকে যায়, ঈর্ষা হয়।

জায়গায় জায়গায় ছোট্ট মন্দির, কোথাও মসজিদ, কোথাও চার্চ। আজও আছে, থাকবে। তা নাহলে উৎসব হবে না। আমরা বাঁচব কী নিয়ে?

রাবণের সীতা হরণ, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম কথা, কংস বধ ইত্যাদি মহাকাব্য বা পুরাণের ঘটনাবলী আমরা ডিসলাইক করি না। নাটক বা যাত্রার গৌরবকে ফিরিয়ে আনতে এখনও আমাদের মাথায় করে রাখার মতো বিষয়। ঝুলনে তুলে ধরা যেতেই পারে এমন সব চিত্র। এছাড়াও ডাক্তার, বাউল, পসরা সাজিয়ে বসা হকার এরা এখনও অপরিহার্য যা নিছক পুতুল সাজানো না হয়ে বৃহত্তর ইঙ্গিত বহন করে। এসবের মাঝেই রাধাকৃষ্ণের 'হিন্দোল লীলা'।

ঠাকুমা, দিদিমা, জ্যাঠা, কাকুরা বলে থাকেন আজকের প্রজন্ম অনেক কিছুই দেখতে পেল না।একথা অনস্বীকার্য, অনেক কিছুই সংস্কৃতির প্রবহমান ধারা থেকে লুপ্ত হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। আমরা সে বিষয়ে অবগত নই তা নয়।আসলে আমরা প্রতিদিনের 'ঝুলন' যাত্রায় এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি আলাদা করে শ্রাবণ পূর্ণিমা আর দাগ কাটে না।

মনে পড়ে ছোটোবেলায় যখন ঝুলন সাজাতাম তার জন্য একটা প্রস্ততি পর্ব ছিল। একজন আরেকজনের বাড়িতে নিয়ম করে দেখতে যেতাম বন্ধুরা কে কেমন ঝুলন সাজিয়েছে। ঝুলনের মাটির পুতুল পাওয়া যেত নির্দিষ্ট জায়গায় বাঁধাধরা। যাদের ঘরে স্থান সঙ্কুলান হত না তারা সিঁড়ির তলায় নয়তো বারান্দায় ছোট্ট করে আয়োজন করতো। তবে সাজাতেই হবে।অদ্ভুত আনন্দের খেলা, ঝুলন খেলা। মানসিকভাবে তৃপ্তি দিত কিছু সময়ের জন্য। বাবা-মায়েদেরও উৎসাহ ছিল প্রবল।


এখনও কোলকাতার বেশ কিছু বনেদি বাড়িতে ঝুলন উৎসবের প্রচলন আছে। কিছু কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করছি।


বিনোদ সাহা লেনে মণ্ডল পরিবারের রাধাকৃষ্ণ


ঝুলন বাড়ি বলেই পরিচিত বউবাজারের রামকানাই অধিকারীর বাড়ি। প্রায় ২০০ বছর পুরনো এই পরিবারের রাধাবল্লভ জিউর ঝুলন উৎসব।পাঁচ দিন উৎসব পালন করা হয়।


বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রামকানাই অধিকারীর বাড়ির সঙ্গীতের আসর।রামকানাই পাখোয়াজ বাজাতেন। ঝুলন উপলক্ষে এক কালে আসতেন যদুভট্ট, অঘোরনাথ চক্রবর্তী, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী প্রমুখ শিল্পীরা। পরবর্তীকালে আসতেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, ভিজি যোগ, মালবিকা কানন, এটি কানন, হীরু গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীরা।

চালতাবাগান অঞ্চলে বিনোদ সাহা লেনে বঙ্কুবিহারী সাহা প্রতিষ্ঠিত রাধাকৃষ্ণের ঝুলন মন্দিরে ঝুলনযাত্রা উপলক্ষে বিশেষ পুজো হয়ে থাকে।

ওই একই রাস্তায় মণ্ডল পরিবারের রাধাকৃষ্ণ জিউর মন্দিরে ঝুলন হয়।একাদশী থেকে দ্বিতীয়া পর্যন্ত মোট সাত দিন ধরে চলে এই ঝুলন উৎসব।



অন্য দিকে, কুমোরটুলি অঞ্চলে গোকূলচন্দ্র মিত্র প্রতিষ্ঠিত রাধামদনমোহন জিউর মন্দিরে সাড়ম্বরে পালিত হয় ঝুলন উৎসব।

তেমনই দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ রোডে বাওয়ালির মণ্ডল পরিবারের উদয়নারায়ণ মণ্ডল প্রতিষ্ঠিত মদনমোহন জিউর মন্দিরে যা বড় রাস বাড়ি বলে পরিচিত, আজও পালিত হয় ঝুলন উৎসব। এখানে ঝুলন হয় তিন দিন ব্যাপী।

তবে, শুধু কলকাতাতেই নয় মফস্বলের বিভিন্ন মন্দিরেও চলে ঝুলন উৎসব। নদিয়ার শান্তিপুরের বিভিন্ন বৈষ্ণব পরিবার ও মঠে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয় ঝুলন উৎসব।

নবদ্বীপের ঝুলনের আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। এক দিকে যেমন কিছু পাড়ায় দেখা যায় সার্বজনীন ঝুলন উৎসব অন্য দিকে পুরনো মঠে কিংবা মন্দিরে ঐতিহ্যশালী ঝুলন উৎসব। তবে নবদ্বীপের পুরনো মঠে-মন্দিরে আজও মেলে সাবেক ঝুলনের আমেজ। এছাড়াও মথুরা বৃন্দাবনে ঝুলন উৎসব পালিত হয় ঘটা করে।


"গগনে কৃষ্ণ মেঘ দোলে –

কিশোর কৃষ্ণ দোলে বৃন্দাবনে।

থির সৌদামিনী রাধিকা

দোলে নবীন ঘনশ্যাম সনে

দোলে রাধা শ্যাম ঝুলন দোলায়..."


নজরুলের গীতিকাটির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত।পুরাণ মতে রাধিকা হলেন কৃষ্ণেরই অংশ, কৃষ্ণের শরীরের বামভাগ থেকে তাঁর জন্ম। তিনি কৃষ্ণের পরম ভক্তস্বরূপিণী, কৃষ্ণপ্রেমে তিনি পাগল, কৃষ্ণের পরম আরাধ্যা দেবী তিনিই। তাই কৃষ্ণকে পেতে গেলে রাধার উপাসনাও অবশ্যকর্তব্য। রাধার কৃপা থাকলে অতি সহজেই কৃষ্ণকে লাভ করা যায়। আবার রাধার শক্তিতে কৃষ্ণ বলবান, তাই এরা এক ও অভিন্ন। বৈষ্ণব তত্ত্বে একে বলে অদ্বৈতভেদাভেদ।রাধাকৃষ্ণের প্রেমময় মূর্তিকে দোলনায় স্থাপন করে মূর্তিযুগলকে ঝোলানো, ঝুলন-যাত্রা বা হিন্দোল লীলা।


'ঝুলন যাত্রা' আমাদের সংস্কৃতির অংশ। সাহিত্যে 'ঝুলন' বারবার উঠে এসেছে কখনও পূর্ণাঙ্গ রুপে, কখনও ছন্দে, কখনও উপমা-অলঙ্কারে, কখনও ভাবের আতিশয্যে। সে সব সৃষ্টি অমর হয়ে থাকবে যেমন বেঁচে থাকবে 'ঝুলন'--সমাজে জীবনে মননে।

জীবন যাত্রা যেমন আপগ্রেড হচ্ছে তেমন 'ঝুলন যাত্রা'-ও হতেই পারে।