খলিসানির মান্না বাড়ির সুপ্রাচীন জগদ্ধাত্রী পূজা - Pralipta

মান্না বাড়ির প্রতিমা

অনির্বাণ সাহা: সরস্বতীর পূর্বে ও ভাগীরথীর পশ্চিমে অর্থাৎ সরস্বতী ভাগীরথীর মধ্যভাগে অবস্থিত এই চন্দননগর । মনে করা হয় ভাগীরথী বা গঙ্গার চাঁদের মত বাকের থেকেই এই শহরের নাম হয়ে উঠেছে চন্দননগর । এই শহরের ইতিহাস বহু প্রাচীনকাল থেকেই যথেষ্ট সমৃদ্ধ ।  বহু শক্তি এই শহরে তাদের শাসনকালে আধিপত্য চালিয়েছে, শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ বছর এই শহর ছিল ফরাসিদের অধীনে । ফরাসিদের অধীনে থাকাকালিন সময়ে ফরাসিদের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতির মধ্যেও চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজা ছিল বিশেষভাবে আকর্ষণীয় ও উল্লেখ্য ।  বারোয়ারি পূজার সাথে সাথে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের বা অনেক বনেদি বাড়িতেও জগদ্ধাত্রী পুজো হত তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এই খলিসানির মান্না বাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজা ।

মান্না বাড়ির ২০০১-সালের প্রতিমা

বর্তমানে খলিসানির বনেদি "মান্না পরিবার" মূলত শিয়াখালার বাসিন্দা ছিল । আনুমানিক ১৭১-৭২ বছর  (আনুমানিক ১৮৪৯-৫০ সালে) আগে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক কারণে শিয়াখালার বাসিন্দা শ্রীযুক্ত লক্ষীনারায়ণ মান্নার পুত্র প্রসিদ্ধ কাষ্ঠ ব্যবসায়ী শ্রীযুক্ত মধুসূদন মান্না ও তার পত্নী শ্রীমতি যাদুমনী দাসী তাদের দুই পুত্র রঘুনাথ মান্না ও যোগীন্দ্রনাথ মান্নাকে নিয়ে সপরিবারে এবং স্ববান্ধবে গঙ্গাধরপুর হয়ে অবশেষে চন্দননগরের গঙ্গার ধারে এসে উপস্থিত হয় ।  পারিবারিক সূত্রে মধুসূদন মান্নার দুই পুত্রও কাষ্ঠ ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল । রঘুনাথ মান্না মহাশয়ের নাতি শ্রীযুক্ত মোহন্ত মান্না মহাশয় (শ্রীযুক্ত নিতাইচরণ মান্না মহাশয়ের পুত্র) জানান যে, তৎকালীন সময়ে তারা প্রাথমিকভাবে সেখানেই ছোট কুড়ে ঘর ও খরের ছাউনি দিয়ে বসবাস আরম্ভ করে । চন্দননগরে বসবাস শুরু করার পরেও শ্রীযুক্ত মধুসূদন মান্না কাষ্ঠ ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ছিল, নিজ হাতে জানলা-দরজা, খাট ও অন্যান্য কাঠের উপকরণ প্রস্তুত করতেন ।  জানা যায় বর্তমান হসপিটাল মোড়ের কাছে একটি বাড়িতে তিনি কাঠের কাজ করতেন । সেই সূত্রে সেই পরিবার ও চন্দননগরের অন্যান্য মানুষের সাথে তার একটি ভালো পরিচয় গড়ে ওঠে । পরবর্তী সময়ে আনুমানিক ১৮৫১ সালে খলিসানি অঞ্চলে একটি জমি ক্রয় করে সেখানে প্রথমে ইট, খড় ও টালি দিয়ে ছোট ঘর প্রস্তুত করে সেখানে বসবাস শুরু করেন । পরবর্তী সময়ে দু-কামরার একটি ভবন প্রস্তুত করা হয় । বাড়িটির নাম রাখা হয় "যোগীন্দ্রনাথ ভবন" । এই ভবনের জানলা-দরজা ও অন্যান্য কাঠের উপকরণ তিনি নিজ হাতে প্রস্তুত করেন । পরবর্তী সময়ে তারা সন-সুতো, সুদ, চাল ইত্যাদি ব্যবসার মাধ্যমেও জীবিকা অর্জন করতে থাকে ।

মান্না বাড়ির প্রতিমা

 ব্যবসার উন্নতির সাথে সাথে এই "যোগীন্দ্রনাথ ভবনের" আকার-আকৃতি ও পরিসর বৃদ্ধি পেতে থাকে । বৃদ্ধি পেতে থাকে পরিবারের আভিজাত্য, পরিবারের সদস্য সংখ্যা । কালের নিয়মেই মধুসূদন মান্নার দুই পুত্র রঘুনাথ মান্না ও যোগীন্দ্রনাথ মান্নার বিবাহ সম্পন্ন হয় । পারিবারিক সূত্রে জানা যায় যে, মধুসূদন মান্নার জ্যেষ্ঠপুত্র রঘুনাথ মান্নার পত্নী সত্যবালা দেবীর চার পুত্র ছিল । তারা হলেন যথাক্রমে গৌড়হরি মান্না (পত্নীর নাম প্রভাদেবী মান্না), নিতাইচরণ মান্না (পত্নীর নাম পান্নারানী মান্না), আনন্দ মান্না (পত্নীর নাম তারকরানী মান্না), এবং হাঁকা মান্না । কনিষ্ঠ পুত্র যোগীন্দ্রনাথ মান্না ও তার পত্নী লক্ষ্মীরানী দেবীর পাঁচ পুত্র সন্তান ছিল তারা হলেন যথাক্রমে অনাদিনাথ মান্না (পত্নীর নাম কমলা মান্না), বিভূতিনাথ মান্না (পত্নীর নাম বিজলী প্রভা মান্না), শ্রীপতিনাথ মান্না (পত্নীর নাম কনকবালা মান্না), ভূপতিনাথ মান্না (পত্নীর নাম শান্তিলতা মান্না), এবং পশুপতিনাথ মান্না (পত্নীর নাম মায়ারানী মান্না) ।

মান্না বাড়ির ঠাকুরদালান

 প্রায় ৫০ বছর পর এই ভবন সংলগ্ন অঞ্চলেই খড়ের ছাউনি বিশিষ্ট একটি ঠাকুরদালান নির্মাণ করা হয় । ঠাকুরদালানের দুপাশে দুই ভাই দুইটি বিশাল ভবন (বর্তমানে যা দেখতে পাওয়া যায়) নির্মাণ করেন । বর্তমানে এই পরিবারের সদস্যরা কাঠ, চাল, মিষ্টি ও অন্যান্য ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করে থাকে । এছাড়াও পারিবারিক জমিতে চাষাবাদের মাধ্যমেও কিছু অর্থ উপার্জন করা হয় । এই ঠাকুরদালানেই বর্তমানেও মান্না পরিবারের সুপ্রাচীন জগদ্ধাত্রী পূজা আজও নির্দিষ্ট রীতিনীতি মেনে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে ।

মান্না বাড়ির একটি অংশ

কালের সরণি বেয়ে "মান্না বাড়ির" ঐতিহ্যবাহী দেবী জগদ্ধাত্রী আরাধনা আজও অব্যাহত ।  এই পরিবারের জগদ্ধাত্রী পুজো শুরুর কথা জানা যায় তাদের পরিবারের কিছু সদস্যের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে । তাদের মধ্যে যোগীন্দ্রনাথ মান্না মহাশয়ের নাতবৌ শ্রীমতি মাধবী মান্না মহাশয়া (যোগীন্দ্রনাথ মান্না মহাশয় কনিষ্ঠপুত্র শ্রীযুক্ত পশুপতিনাথ মান্না মহাশয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র তরুণ মান্না মহাশয়ের পত্নী) জানান যে, ১৮ শতকের ৯০ দশকের প্রথমদিকে এই অঞ্চলের আরেক প্রসিদ্ধ পরিবার দাস বাড়িতে দুর্গাপুজা হত বহুদিন আগে থেকে (বর্তমানেও এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়, সাথে এই পরিবারের ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসব কালের গতিতে তার ঐতিহ্য হারালেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি) । সেই পরিবারের ও আঞ্চলিক কিছু ছোট ছেলেরা কার্তিক মাসের শেষের দিকে নিজ হাতে একটি জগদ্ধাত্রী প্রতিমা তৈরি করে এই মান্না বাড়ীর দালানে জগদ্ধাত্রী পুজোর অষ্টমীর দিন রাতের অন্ধকারে খেলার ছলেই রেখে দিয়ে যায় (বর্তমানে কিছুটা কার্তিক ঠাকুর ফেলার রীতি অনুযায়ী) । পরদিন সকালে মান্না পরিবারের সদস্যরা সেই প্রতিমা দেখতে পান । তৎকালীন সময়ে এই পরিবারের কুলোপুরহিত ছিলেন হরিশচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয়ের পিতা । তারই বিধানে সেই প্রতিমার আরাধনা শুরু করেন । সেই বছরই সত্যবালা দেবী জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের কাছে সন্তানলাভের জন্য মানদ করেন । আর দেবী জগদ্ধাত্রীর কৃপায় ঠিক পরের বছরই সত্যবালা দেবীর গর্ভে জন্মলাভ করে মান্না পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান । দেবীর আশীর্বাদে সন্তানলাভের কারণে তিনি সন্তানের নাম রাখেন "গৌড়হরি" । পরপর চার বছর এই পরিবারে দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা অনুষ্ঠিত হয় । কিন্তু তারপর বিশেষ কিছু পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে এই পুজো তারা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় । দেবীর কাঠামোটিও সযত্নে একটি জায়গায় তুলে রাখার বন্দোবস্ত করা হয় । প্রায় ৩-৪ বছর এই পরিবারে দেবী হৈমন্তিকার আগমন ঘটেনি, হয়নি তারা আরাধনা । কিন্তু তারপর এই পরিবারের কুলোপুরোহিত হরিশচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয়ের পিতা একবার হেমন্তের আগমনে দেবীর স্বপ্ন পান । দেবী তাকে মান্না বাড়ির পুজো শুরুর আদেশ দেন । মান্না পরিবারের তৎকালীন সদস্যদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পুনরায় এই পুজো শুরু হয় ১৯০১ সালে (১৩০৪ বঙ্গাব্দ) । প্রথম ১-২ বছর দেবী হৈমন্তিকার আরাধনা এই বাড়িতে ঘট পুজোর মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় । পরবর্তী সময়ে পুনরায় সেই পুরাতন কাঠামোয় খর, মাটি দিয়ে মৃণ্ময়ী জগদ্ধাত্রীর মাতৃমূর্তি প্রস্তুত করে, সেই মূর্তিতে দেবী আরাধনা শুরু হয় যা বর্তমানেও অব্যাহত । 

মান্না বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই দেখা যায় দুপাশে দুই ভাইয়ের বাড়ি এবং মধ্যভাগে লাল রঙের একটি ঠাকুরদালান রয়েছে । বাড়িটির এবং ঠাকুরদালানের (ঠাকুরদালানটির সামনে রয়েছে একটি প্রশস্ত ফাঁকা জায়গা) গঠন দেখলেই এই পরিবার এবং বাড়িটির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে একটি ধারণা গড়ে ওঠে । রঘুনাথ মান্না মহাশয়ের নাতি শ্রীযুক্ত মোহন্ত মান্না মহাশয় এবং তার পত্নী শ্রীমতি গীতা মান্না মহাশয়ার থেকে জানা গেল, ১৯০১ সালে দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা পুনরায় শুরু হলে সেই বছরেই পরিবারের পক্ষ থেকে বার্মা কাঠ দিয়ে দেবীর একটি কাঠামো এবং একটি জলচৌকি প্রস্তুত করা হয় । যা আজও বহু স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে । পুজো শুরুর কয়েক বছরের মধ্যেই খড়ের চালা বিশিষ্ট (বর্তমানে যে স্থানে ঠাকুরদালান রয়েছে ঠিক সেখানেই) একটি ঠাকুরদালান প্রতিষ্ঠা করা হয় । কালের পরিবর্তনের সাথে সাথেই পরিবারের অর্থনৈতিক পরিবর্তন সাধিত হয় । ফলস্বরুপ বাড়ি এবং ঠাকুরদালানে লাগে আধুনিকতার ছোঁয়া । ঠাকুরদালানে মূল গঠন একই রেখে ঘরের ছাউনির পরিবর্তে আসে কংক্রিটের ছাদ । দেয়ালে আগে রঙের প্রলেপ, সাথে দেয়ালে আলপনাও অঙ্কিত হয় । সেই ঠাকুরদালানে দেবী জগদ্ধাত্রীর মাতৃ বন্দনা অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবছর । বাড়ি এবং ঠাকুরদালানটি বহুবার বহু সময়ে সংস্কার করা হলেও, এই বাড়িতে তৎকালীন যুগের একটি কাঠের সিঁড়ি আজও লক্ষ্য করা যায় । যা প্রাচীনত্বের সাথে আধুনিকতার অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটায় ।

মান্না বাড়ির বহু প্রাচীন কাঠের ঠাকুরের চৌকি

পারিবারিক রীতি অনুযায়ী এই পরিবারে দুর্গাপুজোর বিজয়া দশমীর দিন দেবী জগদ্ধাত্রীর কাঠামো পূজা হয় । তারপরে ঠাকুরদালাননেই কুমোর সেই কাঠামোতে খড় এবং মাটি দিয়ে প্রস্তুত করেন দেবী হৈমন্তিকা মৃন্ময়ী মূর্তি । দেবী জগদ্ধাত্রীর পরনের নতুন বেনারসি শাড়ি পরিবারের তরফ থেকে প্রতিবছর দান করা হয় । পরিবারের সদস্যদের থেকে জানা যায় যে, তাদের প্রতিমা মূলত পারিবারিক প্রতিমা হওয়ায় এই প্রতিমার উচ্চতার মূলত ৪-৫ ফুটের মধ্যে থাকতো । তবে পরিবারের সকলের অনুমতিক্রমে ২০০১ সাল থেকে এই প্রতিমার উচ্চতা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৬-৬.৫ ফুট হয় ।  প্রতিমার ডানদিকে হাতি এবং সিংহের মুখ থাকে । পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুসারে কোনো বছর সোনালী সাজে বা কোন বছর ডাকের সাজে সুসজ্জিতা হয়ে দেবী আবির্ভূতা হন । প্রতিমার সাজের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই প্রতিমার পিছনে একটি চালচিত্র থাকে । এই পরিবারের প্রতিমার গায়ের রং গোলাপি এবং মুখশ্রী লাবণ্যময়ী ।


চন্দননগরের বারোয়ারিগুলিতে জগদ্ধাত্রী পুজো চারদিন ধরে পালিত হলেও মান্না পরিবারে শুধুমাত্র একদিনের পূজার রীতি চালু রয়েছে । শুধুমাত্র মহানবমীর দিন তিনটি অর্ধে বা পর্যায়ে সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীর পূজা একত্রে অনুষ্ঠিত হয় । পূজার সময় ফল, মিষ্টান্ন ও নৈবেদ্য সহ মোট ৬৪টি থালা দেবী জগদ্ধাত্রীকে উৎসর্গ করা হয় । এটি প্রায় প্রারম্ভিক বস থেকেই এই পরিবারে চালু রয়েছে । বৈষ্ণব মতে এই পরিবারের পুজো অনুষ্ঠিত হওয়ায় এই পুজোয় কোনরূপ বলি দেওয়া হয় না ।  একদিনে তিনটি অর্থে বা পর্যায়ে দেবী হৈমন্তিকার পূজাপাঠ করা হলেও দেবীর উদ্দেশ্যে কোন রকম খিচুড়ি ভোগ বা অন্নভোগ উৎসর্গ করার রীতি এই পরিবারে চালু ছিল না, বর্তমানেও নেই । তবে অষ্টমী পূজোর সময় বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই পরিবারের তরফ থেকে ভান্ডারা (পারিবারিক মতে এই ভান্ডারা কথার অর্থ হল লুচি এবং বোদে ভর্তি প্যাকেট । দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার পর যা অষ্টমী পুজোর সময়ে উপস্থিত পরিবারের সকল সদস্য ও দর্শনার্থীদের দেওয়া হয়) দেবার রীতি বর্তমানেও অব্যাহত । দেবী জগদ্ধাত্রী,  দেবী দুর্গার এক অন্যরূপ হওয়ায় এই পুজোতেও সন্ধিপূজার সময়ে (মহাঅষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে) ১০৮ প্রদীপ প্রজ্বলিত করে বিশেষ পূজার রয়েছে । মহানবমীর পূজার সময় পারিবারিক রীতি অনুযায়ী এই পরিবারে কুমারী পুজোর রীতি প্রচলিত রয়েছে । পারিবারিক রীতি অনুযায়ী ১০ বছরের কমবয়স্কা কোন ব্রাহ্মণ বালিকাকে প্রতিবছর কুমারী হিসেবে গ্রহণ করা হয় । পরিশেষে ধুনো পোড়ানোর মাধ্যমে পূজার সমাপ্তি হয় ।

২০২১ -এর মূর্তি 

মান্না বাড়ির দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনার ৯৯তম বর্ষে অর্থাৎ ২০০০ সালে এই পরিবারের আকাশে নেমে আসে ঘন কালো মেঘ । রঘুনাথ মান্না মহাশয়ের নাতি শ্রীযুক্ত মোহন্ত মান্না মহাশয়ের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে জানা গেল যে, উক্ত বছরে তার খুড়তুতো ভাই সদাহাস্যময়, প্রাণচঞ্চল শ্রীযুক্ত নির্মল মান্না মহাশয় (যোগেন্দ্রনাথ মান্না মহাশয়ের ছোট নাতি) মাত্র ৩৬ বছর বয়সেই কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন । উক্ত ঘটনায় মানসিকভাবে পরিবারের সকলের মন হয়ে ওঠে ভারাক্রান্ত । এর আগেও পরিবারের অনেকেই ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে গমন করেছেন । কিন্তু কোনবারই মান্না পরিবারের দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা বন্ধ হয়নি । কিন্তু এইবার প্রত্যেকের মন এতটাই ভারাক্রান্ত ও আবেগঘন হয়ে ওঠে যে, উক্ত বর্ষে পূর্বের রীতি ভেঙে পরিবারের তরফ থেকেই বন্ধ করা হয় এই পরিবারের পারিবারিক জগদ্ধাত্রীর আরাধনা ।

কিন্তু চতুর্ভূজা দেবী জগদ্ধাত্রী তো সেটা চান নি । তাই পরবর্তী বছরেই অর্থাৎ ২০০১ সাল থেকে পুনরায় এই পরিবারের মাতৃবন্দনায় শুরু হয় । কিন্তু পারিবারিক এই পুজো ভেঙে দু-টুকরো হয়ে যায় এই পরিবারের রঘুনাথ মান্না ও যোগেন্দ্রনাথ মান্না মহাশয়ের দুই পরিবারের মধ্যে । তাদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে স্থির হয় যে, তারা এখন থেকে পালা করে প্রতিবছর এই পূজা অনুষ্ঠিত করবেন ।  পারিবারিক আলোচনার মাধ্যমেই স্থির হয় ২০০১ সালের পুজো রঘুনাথ মান্না পরিবারের পরিবারবর্গরা আয়োজন করবেন । কিন্তু প্রচণ্ড অর্থাভাবের জন্য রঘুনাথ মান্না মহাশয়ের নাতি শ্রীযুক্ত মোহন্ত মান্না সেই বছর মূর্তি পূজা না করে ঘট পূজার মাধ্যমেই চতুর্ভূজা দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা সম্পন্ন করবেন বলে স্থির করেন । পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে শ্রীযুক্ত মোহন্ত মান্না মহাশয় জানান যে, এই সিদ্ধান্ত নেবার ঠিক পরেই তার বিবাহিত কন্যা শ্রীমতি পলি মান্না দেবীর স্বপ্ন পান । স্বপ্নে দেবী তাকে দর্শন দেন এবং মান্না বাড়ির ঠাকুরদালানে উপস্থিত হয়েছেন বলে জানান দেন ।  পরদিন সকালেই শ্রীমতি পলি মান্না গতরাতের স্বপ্নের কথা তার বাবাকে জানান । কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই । উক্ত বর্ষে শ্রীযুক্ত মোহন্ত মান্না মহাশয়ের আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভালো ছিল না, তাই তার পক্ষে কোনভাবেই মূর্তি পূজার আয়োজন করা সম্ভব ছিল না । কিন্তু দেবীর স্বপ্নে দর্শন দেওয়াও তো মুখের কথা নয় ! সেটাও তো দেবীর আদেশ স্বরূপ । তাই পরিবারের সকলের মিলিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকলেই ঘট পূজার পরিবর্তে মূর্তি পূজার সিদ্ধান্ত নেন । কিন্তু ততদিনে দূর্গা পূজার বিজয়া দশমী অতিক্রান্ত ফলস্বরূপ পারিবারিক রীতি মেনে দূর্গাপূজার দশমীর দিন কাঠামো পূজা করা সম্ভবপর হয়নি । কিন্তু প্রতিমা পূজার সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয়েছে তখন কাঠামো পূজা তো করতেই হবে । তাই আবার ব্রাহ্মণের দ্বারস্থ হলেন পারিবারিক সদস্যরা । ব্রাহ্মণের বিধান অনুযায়ী ২০০১ সালে লক্ষ্মী পুজোর দিন দেবী জগদ্ধাত্রীর কাঠামো পূজিত হয় মান্না বাড়িতে । তারপরেই কুমোর মান্না বাড়ির ঠাকুরদালানে সেই পূর্বের মত আবার খর-মাটি দিয়ে চতুর্ভুজা দেবী জগদ্ধাত্রীর মৃন্ময়ী রূপদান করেন । এই বছর থেকেই প্রতিমার উচ্চতা পূর্বের থেকে কিছুটা বৃদ্ধি পায়, পরিবর্তন আসে প্রতিমার সাজসজ্জায় ।


পূর্বে এই মান্না পরিবারের জগদ্ধাত্রী পূজা উপলক্ষে আঞ্চলিক ছেলেমেয়েদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো । সাথে থাকত যাত্রাপালা, নাটক ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । এই অনুষ্ঠান আয়োজনের উপলক্ষে পরিবারের তরফ থেকে কংক্রিটের একটি মঞ্চও তৈরি করা হয় । যা বর্তমানে বয়সের ভারে বৃদ্ধ ও অবসন্ন । বর্তমানে পূজা উপলক্ষে সেরকমভাবে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হয় না । পরিবারের তরফ থেকে বা আঞ্চলিক বাসিন্দাদের উদ্যোগে কখনো-সখনো বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু অনুষ্ঠান নিজেদের মধ্যে ছোট করে আয়োজন করা হয় ।

চতুর্ভূজা দেবী জগদ্ধাত্রীর আবাহন যেমন আছে তেমনই বিসর্জনও আছে । সেই রীতি মেনেই ঐতিহ্যবাহী মান্না পরিবারের দেবী জগদ্ধাত্রীর বিসর্জন হয় বিজয়া দশমীর দিন । শ্রীযুক্ত মোহন্ত মান্না মহাশয় জানান যে, খলিসানির এই বাড়ি থেকে পারিবারিক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের কাঁধে করে দেবী জগদ্ধাত্রী "সোজা ঘাটে" বিসর্জিত হন । এই রীতি পূজার প্রারম্ভিক বর্ষ থেকেই প্রচলিত রয়েছে । আনুমানিক ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই রীতি প্রচলিত ছিল । কালের পরিবর্তনে এই পরিবারের আর্থিক পরিবর্তনও হয় । ফলে কাঁধে করে দেবী জগদ্ধাত্রীকে বিসর্জন করার পরিবর্তে ভ্যান বা টানা গাড়ি করে নিয়ে যাওয়ার রীতি প্রচলিত হয় । বর্তমানে  ভ্যান বা টানা গাড়ির পরিবর্তে ২০০১ সাল থেকে আসে ছোট হাতি । এই ছোট হাতি করেই বর্তমানে বিজয়া দশমীর দিনে মান্না বাড়ির দেবী জগদ্ধাত্রী ঢাকের বাদ্যি সহযোগে কৈলাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন । বিজয়া দশমীর দিন পারিবারিক মহিলাদের মধ্যে সিঁদুর খেলার রীতি বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত রয়েছে । ঠাকুর বিসর্জন করে এসে পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে শুভ বিজয় অভিনন্দন আদান-প্রদান ও মিষ্টিমুখ করা হয় ।

বহুদিন থেকেই এই পরিবারের কুলোপুরহিত হিসেবে স্থানীয় বাসিন্দা চক্রবর্তী পরিবার নিযুক্ত ছিল । চক্রবর্তী পরিবারের হরিশচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয় মান্না পরিবারে বংশানুক্রমে দীর্ঘদিন কুলোপুরোহিত হিসেবে ছিলেন । কিন্তু তিনি গত হবার পর চক্রবর্তীর পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশা ছেড়ে দেয় । ফলস্বরূপ মান্না পরিবারকে নতুন ব্রাহ্মণের সন্ধান করতে হয় । খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা অন্য এক চক্রবর্তী পরিবারের ব্রাহ্মণের সন্ধান পান । ২০০১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই পরিবারের জগদ্ধাত্রী পূজার প্রধান পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন শ্রীযুক্ত জয়ন্ত চক্রবর্তী মহাশয় । পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায় প্রায় প্রারম্ভিক সময়কাল থেকেই তাদের পরিবারে জগদ্ধাত্রী পূজার বাজনদার হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন নিকটবর্তী খন্যান অঞ্চলের ঢাকিরা । যা নির্দিষ্ট রীতি মেনে আজও অব্যাহত । বর্ত্তমান বছরে (২০২১) এই মান্না বাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজা ১২০ বছরে পদার্পণ করল ।


যোগসূত্র : 
রঘুনাথ মান্না পরিবারের নাতি শ্রীযুক্ত মোহন্ত মান্না মহাশয়ের পুত্র শ্রীযুক্ত রীতেশ মান্না ।

তথ্যসূত্র :
-- রঘুনাথ মান্নার জ্যেষ্ঠপুত্র গৌড়হরি মান্নার পত্নী প্রভাদেবী মান্নার সাথে আলাপচারিতায় মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাবলী ।
-- রঘুনাথ মান্না পরিবারের নাতি শ্রীযুক্ত মোহন্ত মান্না, তাঁর পত্নী শ্রীমতি গীতা মান্না এবং তার ভাইপো শ্রীযুক্ত জয়দেব মান্না মহাশয়ের (মোহন্ত মান্না মহাশয়ের সহোদর ভ্রাতা কাশীনাথ মান্নার পুত্র) সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাবলী ।
-- যোগীন্দ্রনাথ পরিবারের নাতি শ্রীযুক্ত তরুণ মান্না মহাশয়ের পত্নী শ্রীমতি মাধবী মান্না মহাশয়ার সাথে আলাপচারিতায় মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাবলী ।

ক্ষেত্র সমীক্ষক :
শ্রীযুক্ত অজিত মুখোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত অনির্বাণ সাহা ।