শহীদ কানাইলাল দত্ত - Pralipta


TFHC: হুগলী জেলার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে প্রতি কোনায় কোনায় ছড়িয়ে রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা। দেশ স্বাধীনের জন্য যারা নিজের সর্বস্ব দিয়েছেন, এমনকি প্রাণ ত্যাগও দিয়েছিলেন। হুগলীর চন্দননগর অঞ্চলেও এমন সংগ্রামীদের নাম জানা যায়, তার মধ্যে থেকে কানাইলাল দত্ত - এর নাম উল্লেখ্য। ক্ষুদিরামের পরই শহীদের খাতায় দ্বিতীয় নামটি হল কানাইলাল দত্তের।

হুগলী চন্দননগরে জন্মাষ্টমী তিথিতে ৩০ - শে আগস্ট ১৮৮৮ সালে (বাংলার ১৪- ই ভাদ্র ১২৯৫) কানাইলাল দত্ত জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তারপর পিতা চুনিলাল দত্তের কর্মসূত্রে ৬ বছর বয়সে কানাইলাল বোম্বাই (বর্তমানে মুম্বাই) চলে যান। সেখানে মুম্বাইয়ের গিরগাঁও এলাকার ‘এরিয়ান এডুকেশন সোসাইটি’ পরিচালিত আর্য‍ হাইস্কুলে তাঁর পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়। ১৯০৩ সাল অবধি তিনি মুম্বাইতেই থেকে পড়াশোনা করেছিলেন।১৯০৪ সালে পিতার অসুস্থতার কারণে পুনরায় চন্দননগরে ফিরে এসে ডুপ্লে স্কুলে (বর্তমানে কানাইলাল বিদ্যামন্দির) দশম ক্লাসে ভর্তি হন। এই মুম্বাইতে থাকাকালীন তারমধ্যে মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, তিনি তাঁর দরিদ্র সহপাঠীদের দেখে নিজের সমস্ত বিলাসিতা ত্যাগ করেন, এমনকি তাদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কানাইলাল পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন।১৯০৫ সালে ডুপ্লে কলেজে (বর্তমানে চন্দননগর কলেজ) এফ.এ (বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক) তে ভর্তি হন। এরপর এফ.এ পাস করে ভর্তি হন হুগলী মহসিন কলেজে। ১৯০৮ সালে এখান থেকে বি.এ পাস করেন। বাল্যকাল থেকেই মতিলাল রায়ের সাথে কানাইলালের পরিচয় ছিল। বলা যায়, কানাইলাল - এর বিপ্লবী কাজকর্মের উৎসাহ পাওয়া মতিলাল রায়ের কাছ থেকেই। স্কুলে পড়াকালীন চন্দননগরের বিপ্লবী চারুচন্দ্র রায় - এর সান্নিধ্যে আসেন। কানাইলাল তাঁর কাছ থেকেই অস্ত্র চালনা শেখেন। এরপরেই কানাইলাল - এর বিপ্লবী জীবনের পথ চলা শুরু হয়।

চন্দননগরে কানাইলাল দত্ত বি.এ পরীক্ষা শেষ  করে দেশপ্রেমে নিজেকে উৎসর্গ করতে কলকাতায় এসে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হয়ে তিনিও সর্বপ্রথম ইংরেজদের উচ্ছেদকারী ত্রিশজন বীরসন্তানদের মত রাজদ্বারে অভিযুক্ত ছিলেন।  তিনি  বিভিন্ন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ছোটলাট স্যার এন্ড ফ্রেজারকে বারবার প্রাণনাশ করতে গিয়েও ব্যর্থ হন, চন্দননগরের মেয়র তার্দিভেল সাহেব-এর শয়নকক্ষে বিস্ফোরক ফেলা, কিংসফোর্ড হত্যা তাঁর পরিকল্পনা হলেও প্রফুল্ল চাকীর সঙ্গে ক্ষুদিরাম বসু মজঃফরপুর যাত্রা করেন। তাঁর এই অল্প বয়সেই বীরত্বের কাহিনী অতি বিরল। বারীন্দ্রকুমার ঘোষ-এর সহায়তায়  কানাই লাল দত্ত হেমচন্দ্র কানুনগো কাছ থেকে বোমা তৈরীর কাজে যোগ দিয়েছিলেন গোপীমোহন দত্ত লেনের একটি বাড়িতে। কিংসফোর্ড হত্যার চেষ্টায় ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়ার পর ইংরেজ পুলিশ বিপ্লবীদের সমস্ত ঘাঁটি আক্রমণ করেন। অরবিন্দ ঘোষ উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, ঋষিকেশ কাঞ্জিলাল, বারীন্দ্র ঘোষ, কানাইলাল দত্ত সহ বহু বিপ্লবী ধরা পড়েন। পরে বারীন ঘোষ- এর জবানবন্দিতে নরেন্দ্র গোঁসাই ধরা পড়েন।বারীন্দ্রকুমার-এর সহায়তায় একাধিক বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

 নরেন্দ্র রাজসাক্ষী দিলে (অরবিন্দ ঘোষ কে বাঁচানো সম্ভব হত না) সেইজন্য কানাইলাল দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ কয়েকজন বিপ্লবী দেশদ্রোহী নরেন্দ্র গোসাঁইকে হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। এই সময়ে নরেন্দ্র গোসাঁইকে পুলিশ কড়া নিরাপত্তায় জেলের ভেতরে রেখেছিল। তাঁকে হত্যার জন্য রিভলবার তুলে দিয়েছিলেন চন্দননগর-এর মতিলাল রায়।এই দুটি গুলিভরা রিভলবার শ্রীশচন্দ্র ঘোষ ও বসন্ত বন্দোপাধ্যায় -এর মাধ্যমে জেলখানায় কানাইলাল ও সত‍্যেন্দ্র  হাতে এসে পৌঁছল। তারা দুজনেই রিভলবার পেয়ে  অসুস্থতার অজুহাতে জেল হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চাতুর্যের দ্বারা নরেন্দ্রকে ডেকে পাঠালেন।নরেন্দ্র গোসাঁই আসামাত্র  সত্যেন্দ্র গুলি ছুঁড়লেন,কিন্তু প্রাণনাশ না হওয়ায় কানাইলাল-এর বন্দুকের গুলিতে তাঁর রক্তাক্ত দেহ মাটিতে শুয়ে পড়ল।

এরপরই বিচারে কানাইলাল ও সত্যেন্দ্র ফাঁসির আদেশ হয়। কানাইলালের দাদা আশুতোষ দত্ত দন্ডরোধের জন্য উকিলের দ্বারস্থ হলেও তিনি বিরোধিতা করায় আবেদন করা হয়নি।১৯০৮ সালের ১০-ই নভেম্বর কানাইলালের ফাঁসির দিন নির্ধারিত হলে তাঁর মুখমণ্ডল প্রফুল্ল চিত্তে ভরে উঠেছিল। দেশমাতৃকার সেবায় নিজহস্তে মাত্র ২০বৎসর ২ মাস ১০ দিন বয়সে ফাঁসির দড়ি গলায় পরে বীর সন্তান কানাইলাল দত্ত শহীদ হলেন। 

কানাই লাল দত্ত-এর শবদেহ ক‍্যাওড়াতলা মহাশ্মশানে দাহ করা হয়েছিল। সেই দিন অসংখ্য নর-নারী জমায়েত ঘটেছিল।বহু শ্বেতাঙ্গরাও  নিজের বাড়ির বারান্দা থেকে তাঁকে একটিবার দেখার জন্য ব্যাকুল নয়নে অপেক্ষা করেছিল।তাঁর চিতাভস্ম  উপস্থিত সকলেই সোনার কৌটো,রৌপ‍্য কৌটো,গজ দম্ভের মধ‍্যে বাড়ি এনেছিলেন। দেশবৈরী বিপ্লবী নরেন্দ্র গোসাঁই-র হত্যায় সমগ্র বিপ্লবীদের জীবনদানে কানাইলাল দত্ত-র বীর আত্মত্যাগ ভারত মাতাকে স্মরণ করে দেন যে তিনি আমাদের মধ্যে উপস্থিত না থেকেও চিরন্তনের জন্য রয়ে গেছেন।