আনুমানিক ৩০০ বছরের ঊর্ধ্বে চুঁচুড়ার বড় জগন্নাথ ঠাকুরবাড়ি - Pralipta

জগন্নাথের মূর্তি 
 
TFHC: ঐতিহ্যের শহর চুঁচুড়া। চুঁচুড়া শুধুমাত্র হুগলির সদর শহর বলেই ক্ষান্ত নয়, চুঁচুড়া শহরের সমস্তটাই আস্ত এক আভিজাত্যের ভান্ডার। মানুষের আবেগ, অনুরাগ, নিষ্ঠা, শ্রদ্ধা ও ঐকান্তিকতা এই সবকিছু একটি ঐতিহাসিক নিদর্শনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক তেমনি চুঁচুড়ার বড় জগন্নাথ বাড়ি। ষন্ডেশ্বরতলার কাছেই, শ‍্যামবাবুর ঘাট দুর্গোৎসব কমিটির নিকটে অবস্থিত চুঁচুড়ার বড় জগন্নাথ বাড়ি, যার ইতিহাস আজও ধুলার চাদরে লিপ্ত এবং জনসম্মুখ থেকে আড়ালে রয়ে গেছে বছরের পর বছর। সেই ইতিহাস উন্মোচনের কার্যে আমরা টিম প্রলিপ্ত ব্রতী হয়েছি, আসুন জেনেনি চুঁচুড়ার বড় জগন্নাথ বাড়ির সম্বন্ধে।

রথের ছবি ও দালানের টানানো ছবি
 
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাকাল:

আনুমানিক ৩০০ বছর পূর্বে শ্রী রায় শ্যাঁমচাঁদ ধর বাহাদুর মহাশয় এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। শোনা যায় যে, শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভুর মূর্তি তাদের পাশে থাকা গঙ্গার ঘাটে ভেসে এসেছিলেন, তারপর জগন্নাথ মহাপ্রভুকে এই বাড়ির কর্তারা নিয়ে আসেন এবং নিজেদের বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন। তখন এই বাড়ি মল্লিকবাড়ি নামে পরিচিত ছিল। জগন্নাথ দেব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছু বছর পরেই তারা 'ধর' উপাধি অর্জন করেন। তারপর থেকেই এই বাড়ি ধর বাড়ি নামে পরিচিতি পায়। এই ধর বাড়ি ছিল এক সময় এখানকার জমিদার বাড়ি, তাদেরই অধীনে চলত শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভুর পূজা পাঠ এবং নিত্য সেবা। কাজেই পরবর্তীতে এই ধর বাড়ির উত্তরসূরীরা তাদের কুলদেবতাকে অত্যন্ত ভক্তি এবং শ্রদ্ধার সাথে সেবা করে চলেছেন।
 
জগন্নাথের মূর্তি 

অধিষ্ঠাত্রী দেব/দেবী:

চুঁচুড়ার বড় জগন্নাথ বাড়ি ওরফে ধরবাড়ির কুলদেবতা শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভু। তাদের এই মন্দিরে রয়েছে এক বিশেষ চমক। চুঁচুড়ার কিছু প্রাচীন জগন্নাথ বাড়িগুলোর মতনই এখানেও শুধুমাত্র শ্রী জগন্নাথ দেবকে দেখা যায় বলভদ্র ও সুভদ্রার মূর্তি এখানে অনুপস্থিত। জগন্নাথ দেবের মূর্তি নিমের কাঠের তৈরি। বিশেষভাবে বলতে হয় ধরবাড়ির শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভুর আঙ্গুল সহ দু'টি হাত দেখতে পাওয়া যায়। আমরা জানি যে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা, এনাদের মূর্তি নির্মাণ অসম্পূর্ণ হয়েছিল বলে হাত এবং পা ছাড়াই শ্রীধাম পুরীতে জগন্নাথ দেবকে পুজো করা হয় এবং সেই আদলেই জগন্নাথ দেবের মূর্তি জগতে প্রতিষ্ঠা পায়, কিন্তু চুঁচুড়ার বড় জগন্নাথ বাড়ি ব্যতিক্রম। এখানকার এই মূর্তি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। জগন্নাথদেব দুই হাত সামনের দিকে প্রসারিত করে মুষ্ঠি মুদ্রায় আছেন, জগন্নাথ দেবের মুখের বর্ণ তমশা হলেও গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল হলুদ রঙের। সেই কারনে অন্যান্য বাড়িগুলির থেকে চুঁচুড়ার এই ধর বাড়ি অন‍্যতম এবং আলাদা। এছাড়াও জগন্নাথ দেবের সিংহাসন এর নিচের সিঁড়িতে রয়েছেন শ্রী রাধা-শ্যামসুন্দর, শ্রী গোপাল এবং তাদের প্রতিষ্ঠা নারায়ন শিলা। মন্দিরের সিংহাসনে প্রাচীনতার ছোঁয়া দৃশ্যমান এবং সিংহাসনের ডানদিকে ছোট্ট একটি কুলুঙ্গিতে রয়েছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এবং নিত্যানন্দ মহাপ্রভু। আর সেই সিংহাসনের বামদিকের দেওয়ালে একটি কাঠের তাকে রয়েছে এক সুবিশাল গীতা, যা সারা বছরই প্রায় সাদা কাপড় দিয়ে মোড়া থাকে। এছাড়াও মন্দিরের অন্যপ্রান্তে রয়েছেন শিব ঠাকুর, সেই ঘরে নাকি শুধুমাত্র ব্রাহ্মণরাই যেতে পারবেন। যেহেতু ধরবাড়ির সকলেই অব্রাহ্মণ তাই তাদের সেই কক্ষে যাওয়ার কোনো অনুমতি নেই। জগন্নাথ মন্দিরের থেকে বেরিয়ে বাম হাতে রয়েছে দালান করা শিব দুর্গার মন্ডপ, যেখানে শরৎকালের দেবী দশভুজার আরাধনা হয়ে থাকে।

মন্দিরের ফলক
 
বিশেষত্ব:

 বড় জগন্নাথ বাড়িতে দু'বেলা থাকে নিত‍্য সেবার আয়োজন। সকালবেলায় ঠাকুরকে ফলমিষ্টি দিয়ে পুজো করা হয় কিন্তু সন্ধ্যেবেলায় জগন্নাথ ঠাকুরকে লুচি, মুরকি, তরকারি, দুধ-চিঁড়ে ইত্যাদি দিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয়। মূলত এই ধর বাড়ির কুলদেবতা শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভু তাই রথযাত্রা উপলক্ষে এখানে দেখতে পাওয়া যায় বিশেষ উপাচার। জগন্নাথদেব রথে অধিষ্ঠান করার আগে তাকে মালপোয়া ভোগ দেওয়া হয়, তারপর জগন্নাথ দেবকে রথে চাপানো হলে দেওয়া হয় নটা থালায় অন্নভোগ তার সঙ্গে দেওয়া হয় নটা গ্লাস, সবই কাঁসা এবং পিতলের। শোনা গেল যে, যা দেওয়া হবে সবই নাকি নটা করে দেওয়া রীতি রয়েছে। অন্নভোগের মধ্যে ভাত, ডাল ভাজা সবকিছুই থাকে, এগুলো সব হয় সোজারথের দিন। আরেকটি বিশেষত্ব হলো উল্টোরথের দিন, দেখা যায় শ্রী জগন্নাথ দেবকে সেদিন ৫২ রকম ভোগ নিবেদন করা হয়, আমরা জানি এই যে শ্রীক্ষেত্র পুরীতে জগন্নাথ মন্দিরে ৫৬ ভোগ দেওয়ার রীতি রয়েছে কিন্তু চুঁচুড়া শহরের এই বাড়ি ব্যতিক্রম, শুধুমাত্র বাহান্ন রকমের ভোগ দিয়ে ঠাকুরকে সেবা দেওয়া হয়। ৫২ রকম ভোগের মধ্যে থাকে পাঁচ রকমের খিচুড়ি, ঢেঁড়স ভাজা, আলু ভাজা, বেগুনি, আলু বড়া, পটল ভাজা, রুটি, লুচি পায়েস, সুজি, দই বড়া, আমড়ার টক, আমের টক, মিষ্টি ইত্যাদি। ধর বাড়ির এই রীতি খুবই জাঁকজমক করে পালন করা হয় এবং জানা গেল যে পৈতেওয়ালা উড়িয়া ব্রাহ্মণ এইসমস্ত ভোগের রান্নাবান্না নিয়ন্ত্রণ করেন, বাড়ির কোন সদস্যই সেই কাজে যোগদান করার অনুমতি পায় না, এমনকি এই রান্নাগুলো তাদের নিজস্ব শ্রী জগন্নাথ দেবের রান্না ঘরেই হয়ে থাকে। এই রান্না ঘরে আজও মাটির উনুন বা কাঠের উনুন বলতে যা বোঝা হয় তাই রয়েছে, সেই মাটির উনুনের আঁচেই তৈরি হয় মহাপ্রভুর মহাপ্রসাদ। ব্রাহ্মণঠাকুর নিজের প্রসাদ সরিয়ে নেওয়ার পর এই বাড়ির সদস্যরা সেই মহাপ্রসাদ নিজেদের মধ্যে এবং এলাকাবাসীদের মধ্যে বিতরণ করা শুরু করেন। তাদের মহাপ্রভুর প্রসাদ রাত্রিবেলায় বিতরনের নির্দেশ নেই শুধুমাত্র দিনের আলোতেই বিতরণ করা হয় মহাপ্রভুর ভোগ এবং প্রসাদ।

মন্দিরের সম্মুখভাগ

লোকগাথা:

হুগলীর প্রাচীন বন্দর অঞ্চল আদিসপ্তগ্রামে এক জমিদার ছিলেন, তাঁর মেয়ের নাম ছিল সূর্যমনি দাসী। সূর্যমনি দাসীর গলগন্ড রোগ ছিল যার ফলে তাঁর বিয়ে হচ্ছিল না কোথাও। তখন জমিদার দিশাহীন হয়ে পড়েন এবং ঢ‍্যাঁড়া পিটিয়ে জানান দেয় যে তাঁর একমাত্র কন্যাকে বিয়ে করবে তাকে ১০০ বিঘা জমিসহ তাঁর সম্পত্তির কিছু অংশের মালিকানা লিখে দেওয়া হবে। তখন উত্তর ২৪ পরগনার হালিশহরের এক হতদরিদ্র মল্লিক পরিবারের ছেলে সূর্যমনি দাসীকে বিয়ে করতে রাজি হন এবং বিয়ের আগের দিন রাতে সূর্যমনি দাসী স্বপ্নাদেশ পান জগন্নাথ দেবের এবং তাঁর শ্বশুর বাড়িতেই জগন্নাথ দেবের পুজো করার মনস্থির করেন। বিয়ের দিন সূর্যমনি দেবীকে অনেক গয়না দিয়ে সাজানোর পর নাকি জগন্নাথ দেবের কৃপায় তাঁর গলগন্ড রোগ ঠিক হয়ে যায়। এই ধর বাড়িতে একটি শিবলিঙ্গ আছে যার কথা আগে জানানো হয়েছে। এই ধরদের হুগলীর দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত হিন্দমোটর এলাকায় একসময় প্রচুর চাষের জমি ছিল, কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই চাষ জমি একসময় হাতছাড়া হতে থাকে। সেই চাষের জমিতে নাকি একদিন দেবাদিদেব মহাদেব মাটি ফুঁড়ে ওঠেন এবং স্থানীয় একজনকে স্বপ্নাদেশ দেন যে চুঁচুড়াতে যার বাড়িতে রথ আছে সেই বাড়িতে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে। তারপরে দেবাদিদেবকে এই বাড়িতে এনে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং মহাদেবের এই ঘরে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ প্রবেশ করতে পারবেন, আমরা যা দেখে থাকি সাধারণত মেয়েরাই বাবার মাথায় জল ঢালে ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণ নির্বিশেষে কিন্তু এখানে তা হয় না, একমাত্র তাদের কুলপুরোহিত বাবার মাথায় জল ঢালার অনুমতি পায়। ধরবাড়ির এক পুত্রবধূ আমাদের জানালেন যে একটি লতা নাকি বাবার ওই কক্ষে গিয়ে বাবার মাথায় নিয়মিত অবস্থান করেন এবং সকাল হলে সেই লতা ওই স্থান প্রস্থান করে আবার রাত হলে ফিরে আসে। আরো জানা যায় আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর পূর্বে এক চোর রাত্রিবেলায় এই দেব মন্দিরে চুরি করতে আসে, সে নাকি চুরি করার পর জ্ঞানশুন্য হয়ে ঠাকুরের সিংহাসন এর সামনে পড়ে যায় এবং সকাল হলেই বাড়ির সদস্যরা আবিষ্কার করেন সেই চোরকে এবং সেই চোর জানায় তার সাথে কি হয়েছিল তা সে নিজেও জানে না তবে চুরি করার পর সে কোন দিকদিশা না পেয়ে এই মন্দিরের গর্ভগৃহে জ্ঞান হারায়। এই সমস্ত জনশ্রুতি ও লোকগাথা বছরের পর বছর ধরে এই বাড়ির সদস্যগণ আগলে রেখেছেন এবং তাদের পূর্বপুরুষদের ক্রিয়াকর্মের শ্রদ্ধাঞ্জলি স্বরূপ জাগ্রত মন্দিরকে বাঁচিয়ে রেখেছেন ভালোবেসে। 

শিবলিঙ্গ ও ঠাকুরের রান্নাঘর

নবনির্মাণ/সংস্করণ:

 প্রথমত বাড়িটি খুবই সুন্দর অবস্থাতেই রয়েছে এখনও প্রাচীনতার ছাপ দৃশ্যমান হলেও এ বাড়ির সকলেই অত্যন্ত যত্ন নিয়ে আগলে রেখেছেন বাড়িটি। বাড়িটির মধ্যে রয়েছে সুবিশাল এক উঠোন, উঠোনের দক্ষিনে রয়েছে এক বিশাল মুক্ত মঞ্চ যেখানে অনুষ্ঠান হয়ে থাকে পূজো উপলক্ষে, উঠোনের পশ্চিম দিকে রয়েছে শ্রী জগন্নাথ জীউ এবং উত্তরে রয়েছেন শ্রী শিব দুর্গা এবং পশ্চিমের একটি ঘরে নিম কাঠের তৈরি শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভুর রথ রয়েছে। 

৯-টি গ্লাস ও মন্দিরের গীতা
 
বর্তমান অবস্থা:

বাড়ির সকলে মিলেই এই মন্দির সহ বাড়িকে যত্নে রেখেছেন, তাদেরই উদ্যোগে এবং মহাপ্রভুর কল্যাণে সবকিছু আজও বহাল তবিয়তে এগিয়ে চলেছে। প্রতি বছর নাকি পালা করে করে এক এক ভাইয়ের কাছে পুজোর দায়িত্ব পড়ে। একটি মজার কথা জানা গেল এনাদের জ্ঞাতির লোকজন এতই যে প্রতি ভাইয়ের কাছে পালা পরে কমপক্ষে ১২ বছর পর পর। ঐতিহ্যমন্ডিত বড় জগন্নাথ বাড়ি তাকে ঘিরে থাকা এই সমস্ত ইতিহাস করে তুলেছে ধরবাড়িকে আভিজাত্যে পরিপূর্ণ। এনাদের বাড়ির সামনে রথযাত্রা উপলক্ষে একটি মেলা বসে যেখানে প্রচুর মানুষজনের সমাগম ঘটে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে গত দু'বছর না হয়েছে কোন রথ টানা, না হয়েছে কোন মেলা, না হয়েছে কোন ভক্ত সমাগম। সরকারি কোন অনুদান বা দেবত্ব ভাতা থেকে এই পরিবার আজও বঞ্চিত। হুগলী-চুঁচুড়া এমনই এক সমৃদ্ধশালী প্রাচীন জগন্নাথ বাড়ির কথা অনেকেই জানেন না তাই প্রলিপ্ত নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে এই বাড়ির পরম্পরাকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।

জগন্নাথের স্নানঘর এবং চৈতন্য ও নিত‍‍্যানন্দের মূর্তি 
 
তথ‍্যসূত্র:
চুঁচুড়ার বড় জগন্নাথ বাড়ির সদস্য এবং সদস‍্যাগণ ও টিম প্রলিপ্ত।