চুঁচুড়া চৌমাথা বেলতলা ছোট জগন্নাথ বাড়ি - Pralipta

রথের ছবি

TFHC: আদিকাল থেকে এখনও হয়ে আসছে যদি বড় তরফ থাকে তার ছোট তরফ থাকাটাও প্রাসঙ্গিক। যেমন জ্যেষ্ঠপুত্র থাকলে কনিষ্ঠপুত্রও থাকে, ঠিক সেরকম ভাবেই চুঁচুড়ার বড় জগন্নাথ বাড়ি যেমন আছে ঠিক তেমনি চুঁচুড়াতে ছোট জগন্নাথ বাড়িও বর্তমান। চুঁচুড়ার চৌমাথা এলাকার বেলতলায় রয়েছে ছোট জগন্নাথ বাড়ি, অনেকে মল্লিকবাড়ির জগন্নাথ মন্দির বলেও ডেকে থাকেন।

শিব মন্দির

প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাকাল:

সালটা ১১৩২ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৭২৫ খ্রিস্টাব্দে এই জগন্নাথ বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন এই বাড়িটি একজন সুদক্ষ পুরুষ, নাম স্বর্গীয় নৃসিংহ দাস দে মল্লিক। তিনি ওলন্দাজদের দেওয়ান ছিলেন। তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন মহাপ্রভু জগন্নাথ দেবের এবং ১৭২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি জগন্নাথ পূজো শুরু করেন। যেহেতু চুঁচুড়াতে তাদের আগে শ্যামবাবুর ঘাট এলাকায় জগন্নাথের পুজো শুরু হয়ে গেছে ধর বাড়িতে তাই প্রথম জগন্নাথ পূজো হিসেবে পরিচিতি পায় ধরবাড়ি, বড় জগন্নাথ বাড়ি হিসেবে এবং এই বেলতলার মল্লিক বাড়িতে জগন্নাথ পুজো ধরবাড়ির পুজো শুরু করার কিছু বছর পরেই শুরু হয় তাই মল্লিক বাড়ি ছোট জগন্নাথ বাড়ি নামে পরিচিত লাভ করে। 

ছোট জগন্নাথ বাড়ি

অধিষ্ঠাত্রী দেবী/দেবী:

প্রথমেই বলে রাখা ভাল এই বাড়ির শ্রী জগন্নাথদেব শুধুমাত্র রথযাত্রা উপলক্ষে জনসমক্ষে আসেন, তাছাড়া সারাবছর তিনি ঠাকুর ঘরেই অধিষ্ঠিত থাকেন এবং মল্লিকবাড়ির লোক ছাড়া বাইরের করোর খুব একটা অনুমতি নেই জগন্নাথ দেবের দর্শন করার জন্য। তাই জন্য আমরা মল্লিকবাড়ি গিয়ে জগন্নাথ দেবের শ্রীবিগ্রহ দর্শন করতে পারিনি এবং বিগ্ৰহের কোনোরকম ফোটো আমরা সংগ্ৰহ করতে সক্ষম হইনি। সম্পূর্ণভাবে ফটো তলাও নিষিদ্ধ। চুঁচুড়ার এই মল্লিক পরিবার ওরফে ছোট জগন্নাথ বাড়ির সদস্যগণ, তারা তাদের ব্যক্তিগত কারণবশত তাদের বাড়ির ঐতিহ্য যে প্রচার পাক সেটা তারা কোনদিনই চাননি, এখনো চান না। যেটুকু জানা গেল এই বাড়ির এক সদস্যর মৌখিক বর্ণনায় যে এখানেও শুধুমাত্র মহাপ্রভু জগন্নাথ দেবের বিগ্ৰহ রয়েছে, না আছে বলভদ্র, না আছে সুভদ্রা। জগন্নাথ দেব নাকি অতীব সুসজ্জিত এবং নানা অলংকারে প্রতিষ্ঠিত, এছাড়াও মন্দিরে রয়েছেন গৌর নিত্যানন্দ মূর্তি, একটি ছোট পিতলের সিংহাসন আছে যাতে তাঁরা অধিষ্ঠান করছেন। এছাড়াও গোপাল ঠাকুর, শ্রী রাধাকান্ত-রাধারাণী ও একটি প্রতিষ্ঠিত পারিবারিক নারায়ন শিলা। এনারা সবাই ছোট জগন্নাথ বাড়ির মন্দিরে পুজো পেয়ে আসছেন বছরের পর বছর ধরে।

বাড়ির ফলক

বিশেষত্ব: 

মল্লিকবাড়ির কুলদেবতা শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভু। আগাগোড়াই বৈষ্ণব পরিবার তাদের। মূলত রথযাত্রাই এই পরিবারের প্রধান উৎসব। রথযাত্রা উপলক্ষে বিশেষ রকম সব আচার এবং পরম্পরা মানা হয়। রথযাত্রা এই বাড়িতে খুব ধুমধাম করে পালন করা হয়। বিশেষ রীতি  যদি বলা হয় তার মধ্যে অন্যতম লক্ষণীয় বিষয় হল এই বাড়ীর রথ কোনদিনই রাস্তায় নামানো হয়নি, প্রথম থেকেই নাকি এই নিয়ম যে তাদের বাড়ির ভিতরের উঠোনেই শ্রী জগন্নাথ দেবকে রথে চাপিয়ে প্রদক্ষিণ করানো হয়। এই বাড়িতে রথের আগের দিন জগন্নাথ মহাপ্রভু আটটি রূপে রূপ দান করা যাকে আমরা সবাই "আটবেশ" বলে জানি। ঠিক তেমনই উল্টো রথের দিন এই বাড়িতে সারারাত শ্রী জগন্নাথ দেব জাগেন, তাঁর সাথে জাগেন এই পরিবারের সদস্য এবং সদস্যারা। এই রীতি মল্লিক বাড়িতে অন্যতম বিশেষ নিয়ম বলে পরিগণিত হয়ে আসছে। এমনকি রথযাত্রার দিন এই বাড়িতে বিশেষ একটি গান গাওয়া হয়, সেই গানটি নাকি মল্লিকবাড়ির কোন এক পূর্বপুরুষ লিখেছিলেন এবং সুর প্রদান করেছিলেন যা আজও বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। যখন রথ টানা হয় সেই বিশেষ গানটি বাড়ির সকলে একসাথে গেয়ে ওঠেন এবং আনন্দ সহকারে প্রভুকে তাদের বাড়ির উঠোনের মধ্যে প্রদক্ষিণ করান। এখানে জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি বলে তেমন কিছু লক্ষ্য করা যায় না। অন্যদিকে তাদের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকেই রয়েছে শ্রীগোপেশ্বর ঠাকুরের মন্দির। এই গোপেশ্বরের মন্দির জন সাধারনের জন্য খোলা রাখা হয়না, সম্পূর্ণটাই রয়ে গেছে মল্লিকবাড়ির অধীনে সেই নৃসিংহ দাস দে মল্লিকের আমল থেকে। রথের দিনে বিশেষ পূজা হয় গোপেশ্বরের মন্দিরে তবে আগে শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভুর পূজা হবে তারপর গোপেশ্বর পূজা শেষ করে শ্রী জগন্নাথ উঠবেন রথে এমনটাই নিয়ম চৌমাথা বেলতলা ছোট জগন্নাথ বাড়িতে। আর দুর্গাষ্টমীতে এই গোপেশ্বরের মন্দিরের বিশেষ সন্ধিপুজো হয়ে থাকে। সারাবছরই শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভুর নিত‍্যসেবা, দুবেলা আরতি ও ভোগ-আহার হয়ে থাকে। তবে সোজা রথ থেকে উল্টোরথ পর্যন্ত তিনবেলা বিশেষ পুজোর নিয়ম রয়েছে।

ঠাকুর দালান

লোকগাথা:

মল্লিকবাড়ির এক সদস্য আমাদের জানান যে কোনরূপ কোন অলৌকিক ঘটনা, লোকগাঁথা বা কোন জনশ্রুতি এই বাড়িতে প্রচলিত নেই। শুধুমাত্র তাদের প্রতিষ্ঠাতা ও পূর্বপুরুষ যিনি স্বর্গীয় নৃসিংহ দাস দে মল্লিক মহাশয় তাকেই একমাত্র শ্রী জগন্নাথ দেব স্বপ্নে আদেশ দিয়েছিলেন তাঁর পুজো শুরু করার, এছাড়া আর তেমন কিছু তাদের বাড়িতে কোনদিন ঘটেনি। কিন্তু অলৌকিকতার জৌলুস না থাকলেও শ্রী জগন্নাথ দেবের মহিমা এই পরিবারের মানুষজন অনুভব করতে পারেন, তাদের এই ঐতিহ্যমন্ডিত শ্রীবিগ্রহ খুবই জাগ্রত বলে মল্লিক বাড়িতে প্রচারিত। 

নবনির্মাণ/সংস্করণ: 

চুঁচুড়া চৌমাথা বেলতলার ছোট জগন্নাথ বাড়িটি অতীতে যেমন ছিল তেমনি আছে শুধু নতুন করে রং করা হয়েছে। বাড়িতে মূল ফটক দিয়ে ঢুকেই বাম হাতে রয়েছে রথ রাখার জায়গা, যেখানে সারাবছর রথটি থাকে। তারপর রয়েছে তাদের বাড়ির উঠোন এবং সেই উঠোনকে কেন্দ্র করে মন্দির এবং বাসযোগ্য গৃহগুলি গড়ে তোলা হয়েছে। উঠোনের দক্ষিণ দিকে রয়েছে শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভুর সেই বিশাল দালান মন্দির এবং বড় বড় থামগুলোতে সেই পুরনো দিনের হ্যাজাক লাইটের কাচের বাক্স গুলি আজও সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মন্দির ঠিক উল্টো দিকেই রয়েছে মুক্ত মঞ্চ, সেই মুক্তমঞ্চে রথযাত্রা উপলক্ষে বা অন্য কোনো পুজোয় সেখানে অনুষ্ঠান হয় বাইরে থেকে শিল্পীরা এসে সেখানে তাদের প্রতিভার প্রদর্শন করেন। বাড়িতে প্রাচীনতার বৈদুর্য বর্তমান এবং এই বাড়ির লোকজন তাদের ঐতিহ্যকে ভালোবেসে বাঁচিয়ে রেখেছেন সেটাই তাদের ধ্যান এবং জ্ঞান‌। আসি এবার রথের বর্ণনায়, সম্পূর্ণ রথটি নিম কাঠের তৈরি রতে ১৫-১৬ ফুট লম্বা। চূড়াতে উড়িষ্যার শিল্পশৈলী বর্তমান এবং রথটি দেখলে বোঝা যায় যে কতটা যত্ন নিয়ে এবং দক্ষ কারিগর দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। রথের গায়ে যে আঁকাগুলো রয়েছে সেগুলো দেখলেই বোঝা যায় কোনো দক্ষ হাতের কীর্তি, সেই পুরনো সময় থেকে আজও রয়ে গেছে আঁকাগুলো। রথের গায়ে রয়েছে রামায়ণ কাহিনী, দশাবতারের চিত্র ইত্যাদি, এককথায় বলতে গেলে এমন একটি সুন্দর এবং সাবেকি রথ দেখা খুবই ভাগ্যের বিষয়।

রথ এই স্থানেই থাকে

বর্তমান অবস্থা:

বর্তমান অবস্থা বলতে মল্লিকবাড়ির অধিকাংশ লোকজন শহরের বাইরে থাকেন, তারা শুধুমাত্র পুজো উপলক্ষে এই বাড়িতে আসে, সমাগম ঘটে এবং দেখা সাক্ষাৎ হয়। এছাড়াও এনাদের একটি ট্রাস্টি বোর্ড আছে, সেখানে শুধুমাত্র এই বাড়ির সদস্যরাই রয়েছেন। কোভিড বিধি মেনেই সমস্ত রথযাত্রা ক্রিয়াকর্ম পালন করা হচ্ছে গত দু'বছর ধরে। হুগলী-চুঁচুড়ার ছোটো জগন্নাথ বাড়ি প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারা আজও বহন করে চলেছে এবং তার সঙ্গে তাদের বাড়ির উল্লেখযোগ্য রীতিনীতি আজও বহমান।

তথ‍্যসূত্র: চুঁচুড়া চৌমাথা বেলতলা ছোটো জগন্নাথ বাড়ির সদস‍্যবৃন্দ এবং টিম প্রলিপ্ত।