চুঁচুড়া লেবুতলা বাবাজি জগন্নাথ জীউ ঠাকুর বাড়ি - Pralipta

মন্দির ও রথের ছবি

কল্পক রায় : হুগলী-চুঁচুড়া প্রাচীন জগন্নাথ বাড়ি গুলির মধ্যে লেবুতলা বাবাজি জগন্নাথ জীউ ঠাকুরবাড়ি অন্যতম। চুঁচুড়ার রথ তলার নিকটে লেবুতলা জগদ্ধাত্রী বারোয়ারির ঠিক উল্টো দিকেই একেবারে রাস্তার উপরেই অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী লেবুতলা বাবাজি জগন্নাথ জীউ ঠাকুর বাড়ি।

বাড়ির সম্মুখভাগ

প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাকাল - 
আনুমানিক ১৩০ বছর পূর্বে শ্রী গোপাল দাস মহন্ত মহাশয়ের হাত ধরেই এই জগন্নাথ ধাম প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রী গোপাল দাস মহন্তের গুরুভাই একসময় এই লেবু তলার বাড়িতে একা ছিলেন কারণ দিনের পর দিন তাঁর কাছের মানুষেরা এক এক করে ইহজগতের মায়া ত‍্যাগ করতে থাকেন। তখনও এই বাড়ি জগন্নাথ ধামে পরিণত হয়নি। তারপর শ্রী গোপাল দাস মহন্ত মহাশয় তাঁর গুরু ভাইয়ের বাড়িতে উপনীত হন এবং শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভুর নিম কাঠের মূর্তি স্থাপন করেন। শ্রী গোপাল দাস মহন্তকে সবাই বাবাজি বলেই চিনতেন, সেই থেকেই এই মন্দিরের নাম হয় লেবুতলা বাবাজি জগন্নাথ জীউ ঠাকুরবাড়ি।
 
প্রধান মূর্তি

অধিষ্ঠাত্রী দেব/দেবী - 
লেবুতলা বাবাজির মন্দিরে জগন্নাথ দেবের বিগ্রহ খুবই সুন্দর এবং সেই প্রাচীনকাল থেকেই এই মন্দিরের জগন্নাথ দেব একই রকমই আছেন, পরিবর্তন কিছু হয়নি বলে জানা গেল। নিম কাঠের তৈরি জগন্নাথ মূর্তি শ্রী গোপাল দাস মহন্ত দ্বারা প্রতিষ্ঠা যা যুগ যুগ ধরে বহমান এবং একই ভাবেই পরবর্তী উত্তরাধিকারীরা প্রভুকে সেবা করে আসছেন। মাঝে সুভদ্রা, বামে বলরাম এবং ডানে জগন্নাথ দেব পাথরের তৈরি সিংহাসনে অধিষ্ঠান করে আছেন এই মন্দিরে। সিংহাসনের একেবারে সামনে রয়েছেন কষ্টি পাথরের গোপাল ঠাকুর এছাড়াও রাধা শ্যাম সুন্দরের যুগল মূর্তি। আর রয়েছেন শ্রী চৈতন‍্যদেব ও নিত‍্যানন্দ প্রভু। রথের দিন খুব সুন্দর করে সাজানো হয় জগন্নাথ দেবকে। নতুন বস্ত্র, অলংকার এবং এবং ফুলের মালা সহযোগে প্রভু আবির্ভূত হন এবং এই বেশে জগন্নাথ দেব রথে চেপে মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

রথের মুহুর্ত

বিশেষত্ব - 
শোনা যায় যখন শ্রী গোপাল দাস মহন্ত মহাশয় নদী পথ পেরিয়ে এই লেবু তলার বাড়িতে আসছিলেন তিনি তখন স্বপ্নাদেশ পান এবং গঙ্গার ঘাটের পাশ থেকেই শ্রী জগন্নাথ দেবের মূর্তিটি উদ্ধার করেন। তারপর তিনি তাঁর গুরু ভাইয়ের বাড়িতে জগন্নাথ দেবকে নিয়ে আসেন এবং তারপর জগন্নাথ মহাপ্রভুকে এই বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন এবং পূজা পাঠ শুরু হয়।

রথের মুহুর্ত

লোকগাথা - 
সেরকম কোনো লোকগাথার কাহিনী এই মন্দিরকে ঘিরে রাখেনি। এমনিই এই মন্দিরের প্রাচীনত্ব দেখলেই বোঝা যায় মন্দিরের ঐতিহ্য এবং আভিজাত্য। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে এবং প্রাচীন নিয়ম রীতি মেনেই এখানে জগন্নাথ দেবের ভজন, পূজন, সাধন অতিবাহিত হয়। এও জানা গেল যে শ্রীধাম পুরীতে যে রীতি-নীতি, পূজার্চনা, ভোগ নিবেদন, পরম্পরা ইত্যাদি মানা হয় সেই নিয়মেই নাকি এই মন্দিরের সমস্ত ক্রিয়াকর্ম অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হয়।

তুলসী মন্ডপ

মন্দিরের নবনির্মাণ ও সংস্করণ - 
আগেই বলা হয়েছে যে এই মন্দিরটি আনুমানিক ১৩০ বছর আগেও মন্দির হিসেবে পরিগণিত হত না, বাসযোগ্য একটি বাড়ি ছিল। তারপর শ্রী গোপাল দাস মহন্ত মহাশয় তাঁর গুরুভাইয়ের বাড়ি মন্দিরে রূপান্তরিত করেন। বর্তমানে মন্দিরটি আগে যেরকম ছিল সেরকমই আছে, সংস্কার তেমন কিছু হয়নি বললেই চলে। মন্দিরটি একটি বিশাল দালান বাড়ির মতন, সামনে রয়েছে বিরাট উঠুন, উঠুনে রয়েছে তুলসী মঞ্চ। মন্দিরটি একচূড়া বিশিষ্ট এবং চূড়াতে শ্রী জগন্নাথ দেবের ধ্বজা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও যেহেতু আগে এই মন্দিরটি বসতবাড়ি ছিল তাই সামান্য কিছু কক্ষ, সিঁড়ি ঘর, বাঁধানো কলতলা এখনও রয়েছে। 

মন্দিরের সম্মুখভাগ

মন্দিরের উঁচু দালানে রয়েছে টিনের ছাউনি, সেটা পেরিয়ে প্রবেশ করতে হবে গর্ভগৃহে যেখানে শ্রী জগন্নাথ দেব, গোপাল ঠাকুর, রাধা শ্যামসুন্দর, চৈতন্যদেব এবং নিত্যানন্দ প্রভুর মূর্তি বিরাজমান। বর্তমানে মন্দিরের উত্তরাধিকারী শ্রী বিজয় বিনয় নায়ক মহাশয় এবং প্রধান সেবায়েত শ্রী প্রসাদ সৎপথি। 

মূল ফলক

এনাদের উদ্যোগেই এবং এলাকাবাসীদের সহযোগিতায় এই মন্দিরের পূজার্চনা এবং সেবা বজায় রয়েছে। প্রতিদিন নিয়মিত ভোগ নিবেদন, ভক্তিগীতি, কীর্তন, গীতা পাঠ এইসমস্ত কিছুই করা হয়। শ্রী বিজয় বিনয় নায়কের দাদু অর্থাৎ তার বাবার মামা স্বর্গীয় নিত্যানন্দ দাস মহন্ত এবং বিজয় বিনয় নায়কের পিসি স্বর্গীয়া সুরঙ্গিনী দাসী এই মন্দিরের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং সেবায়েত ছিলেন। বিজয় বিনয় নায়েকের আর এক জ্ঞাতি স্বর্গীয় বৈষ্ণবচরণ দাস মহন্ত এই মন্দিরকে একসময় দেখভাল করেছেন।

রথযাত্রার দিন মন্দিরটি সুন্দর করে সাজানো হয় এবং সুসজ্জিত রথে শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভু মাসির বাড়ি যান নাম কীর্তন সহযোগে। লেবুতলা বাবাজি মন্দির থেকে হুগলি সংশোধনাগার মাঠ অব্দি যায় তাদের রথ তারপর আবার ফিরিয়ে আনা হয় জগন্নাথ দেবকে দোলায় করে তাদেরই মন্দিরে। রথটি আট দিন ওই মাঠেই থাকে তারপর আবার উল্টো রথের দিন জগন্নাথ দেবকে দোলায় করে ওই মাঠে রাখা তাদের রথে চাপানো হয় তারপর আবার ফিরিয়ে আনা হয়। এক কথায় বলতে গেলে এনাদের মাসির বাড়ি বলে সেরকম কিছু নেই তবে ওই রথে করে নিয়ে যাওয়া টুকু, সেটাই নিয়ম রক্ষার জন্য করা হয়। মন্দিরের সেবায়েতরা, ভক্তগণ এবং এলাকাবাসী এই প্রাচীন রথযাত্রায় যোগদান করেন এবং আনন্দ উপভোগ করতে করতে রথের রশিতে টান দেন। বিশেষ ভোগের আয়োজন থাকে রথের দিন। মালপোয়া, জিভে গজা, বোঁদে, কাঁঠাল ইত্যাদি এই সমস্ত প্রসাদ ভক্তগণ এবং পথচলতি মানুষদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।


... 

তথ‍্যসূত্র : 

লেবুতলা বাবাজি জগন্নাথ জীউ ঠাকুরবাড়ির কতৃপক্ষ ও টিম প্রলিপ্ত