কালনার একশো আট শিবমন্দিরের ইতিহাস - Pralipta


অমিত কুমার সাহা, নিজস্ব সংবাদদাতা :
একশো আট শিব মন্দির, আপামর কালনাবাসীর
ভক্তি, আবেগ, ভালোবাসা মিশে যায় যেখানে। যেখানে কান পাতলেই শোনা যায় ইতিহাসের ফিসফিসানি। চলুন, উঁকি দিয়ে আসি ইতিহাস আর ভক্তির একাত্মতার জায়গা, কালনার একশো আট শিব মন্দিরের ইঁটের পাঁজরের
অন্দরে।

একশো আট শিব মন্দিরের প্রতিষ্ঠা লিপিতে নজর রাখলেই এক ঝলকে মূর্ত হয়ে ওঠে - 

শাকে চন্দ্র শিবাক্ষি সপ্ত কুমিরে শ্রী
তেজচন্দ্রাভিধৌবা সূর্যইব স্থির
রার্পিত চলচ্চন্ড প্রতাপানল:
শম্ভোর্ধাম পরম নবাধিকশত শ্রী
মন্দিরৈর্মন্ডলম প্রকার্ষীম্মহদ
অম্বিকাখ‍্য নগরে কৈলাসমেত্ নব্। 

অর্থাৎ এই 'নবাধিক শত' মন্দিরটি ১৭৩১ শকাব্দে অর্থাৎ ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে তেজচন্দ্র কর্তৃক নির্মিত হয়।এই মন্দির নির্মাণের পূর্বেই ১৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দে বর্ধমানের নবাবহাটে তেজচন্দ্রের মাতা বিষণকুমারী 'নবাধিকশত্' শ্রী মন্দির নির্মাণ করেন।

লোকমুখে একশো আট শিব মন্দির নামে পরিচিত হলেও এর মূল নাম নবকৈলাসমন্দির।
বর্ধমানেও মহারাজা এইরকম একশো আটটি
শিব মন্দির নির্মাণ করান। তবে বর্ধমানের শিব মন্দির চতুষ্কোণ কিন্তু কালনার শিব মন্দির বৃত্তাকার।

এই মন্দিরের স্থাপত্যরীতি দুটি বৃত্তকে কেন্দ্র করে
নির্মিত। প্রথম বৃত্তে ৭৪ টি শিবলিঙ্গের অবস্থান,যারা ক্রমান্বয়ে সাদা ও কালো। মন্দিরের প্রবেশদ্বারের ওপর প্রতিটি শিবলিঙ্গের নামকরণ
লিপিবদ্ধ। দ্বিতীয় বৃত্তে আছে ৩৪ টি সাদা শিবলিঙ্গ। তবে দ্বিতীয় বৃত্তের শিবলিঙ্গগুলি বড় বৃত্তের থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট।

এর ভেতরের মাঝখানে আছে একটি বিরাট কূপ। শোনা যায়,এক বিরাট কম্পাস গর্ত করে এখানে বসিয়ে বৃত্তকে পরিমাপ করে সঠিকভাবে নির্মাণ করার জন্য এই কূপ খনন। আবার কারো মতে এটি শূণ্য অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মের রূপ পরম শিবের প্রতীক। আবার অনেকের মতে,ইদারাটি
সংযোজিত হয়েছে মন্দিরের পূজা পার্বণের প্রেক্ষিতে,এর পেছনে আলাদা কোনো তত্ত্ব নেই।

এই একশো আট শিব মন্দিরের বাইরে তেমাথার মোড়ের পশ্চিম দিকে অর্থাৎ লালদীঘির পূর্বপাড়ে
যে একশো নয় সংখ্যক শিবলিঙ্গটি রয়েছে, তার দরজার শিলালিপিতে একশো নয় সংখ্যাটি চিহ্নিত। এর মধ্যে যে শিব লিঙ্গটি আছে,তা কৃষ্ণবর্ণের।

রাজা তেজচন্দ্র সেই সময় কমলাকান্তের মতো সাধকের সংস্পর্শে এসেছিলেন।তাই হয়তো এই মন্দির প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ একটি তত্ত্ব রয়েছে:
আসলে ১০৮ সংখ্যাটি সিদ্ধ বীজমন্ত্রের প্রতীক। হিন্দুশাস্ত্রে কথিত আছে ১০৮ বার বীজমন্ত্র জপ করলে সকল বাসনা পূর্ণ হয়।

তবে এখানে একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই এসে যায় তাহলে সেখানে ১০৯ মূর্তি কেন?

বর্ধমান ইতিহাস বিশেষজ্ঞ শ্রী যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী বলেছেন যে,জপমালায় যেমন ১০৮ টি বীজ গ্রথিত থাকে এবং মধ্যস্থলে ঈষৎ বড় আকারের একটি বীজ মেরুস্বরূপ থাকে - এই শিবক্ষেত্র
নির্মাণের সময় উক্ত বিধান মানা হয়েছিল। আবার অনেকের মতে এই বিধান মানা হলে ১০৯ নং মন্দিরটি মূল মন্দির সংলগ্ন কোনো জায়গাতেই প্রতিষ্ঠিত হত, বেশ কিছু দূরে স্থাপিত হত না। আসলে সাদা ও কালো শিবলিঙ্গ পুরুষ এবং প্রকৃতির প্রতীক। পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনেই সৃষ্টির আনন্দ। সাধনার গূহ‍্যতত্ত্বে শৈব‍্যসাধনা, বৌদ্ধসাধনা, তন্ত্রসাধনায় পুরুষ ও প্রকৃতির একাত্ম সাধনার বিশেষ উল্লেখ আছে।

আবার কেউ কেউ বলেন, শ্বেতবর্ণ শিবলিঙ্গগুলি
চৈতন্য ও জ্ঞানের প্রতীক। কৃষ্ণবর্ণের শিবলিঙ্গের অর্থ তিনি বোধের অতীত। দশ সংখ্যক শিব রয়েছেন সাধন বৃত্তের বাইরে। সাধন বৃত্তের বাইরে থেকে ভক্ত বোধের অতীত যিনি তাঁর স্বরূপ শক্তিকে উপলব্ধি করতে পারেন না। সাধনা করতে করতে তিনি অর্থাৎ সেই সাধক চৈতন্যজ্ঞান তথা স্বরূপকে উপলব্ধি করেন। ভক্তের উপলব্ধির সময় পর্যায়ক্রমে এই অবস্থা চলতে থাকে। এই অবস্থা চলতে চলতে ভক্ত যখন দ্বিতীয় সাধনবৃত্তে প্রবেশ করেন, তখন সেই অবস্থায় তাঁর স্বরূপ আর ভক্তের কাছে অবোধ্য থাকে না। তিনি ভক্তের উপলব্ধিতে জ্ঞান তথা চৈতন্যস্বরূপে প্রতিভাত হন। ভক্তের চৈতন্য তখন বৈকুণ্ঠের অন্তর্গত তমোগুণ সম্বন্ধরহিত যে শিব লোক, সেই শিবলোকে সর্বদাই সদাশিবের মূর্তি প্রত্যক্ষ করেন। আর পূর্বে উল্লিখিত ইদারাটি যদি নিরাকার ব্রহ্মস্বরূপ পরম শিবের প্রতীক হয়, তবে সাধক শিবলোকের ঊর্ধ্বে ব্রহ্মলোকে উঠে ব্রহ্মস্বরূপ পরম শিবকে প্রত্যক্ষ বা উপলব্ধি করেন।

একশো আট শিবমন্দির নির্মাণের পেছনে অন্য একটি ইতিহাস আছে। বর্ধমানের বহু এলাকা পত্তনি দেবার পর, রাজকোষের সমৃদ্ধি হয়েছিল।এই লক্ষীশ্রী অবস্থায় বর্ধিত আয় থেকে ইংরেজ কোম্পানির যাবতীয় ঋণ পরিশোধ করে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে পত্তনিদারদের খাজনা আদায় থেকে বর্ধমানের রাজকোষ উপচে পড়ে। তখন রাজা তেজচন্দ্র যুবক। উচ্ছৃঙ্খল স্তাবক বৃন্দ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। আবদুল গনি খান বলেছেন যে, তেজচন্দ্র সাবালক হয়ে রাজকার্য নিজ হাতে নেওয়ায় মহারাণী বিষণকুমারী অধিকাংশ সময় অম্বিকা কালনায়
থাকতে লাগলেন।

১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দে অক্ষম রাজা তেজচন্দ্র পুণরায় বিষমকুমারীকে রাজকার্য পরিচালনার ভার দেন।১৭৯৮ খ্রীষ্টানদের বিষণকুমারীর মৃত্যু হয়। এরপর তেজচন্দ্র সংযত হন ও রাজকার্যে মন দেন। ক্রমশ
তিনি ধর্মানুরাগী হয়ে ওঠেন। তেজচন্দ্র শৈব পশ্বাচারী ও কৌলসংজ্ঞক ছিলেন। বেদোক্ত মতে
কামসঙ্কল্পসহ যাঁরা দেবতার উপাসনা করতেন, তাঁদের পশ্বাচারী বলা হয়। তেজচন্দ্র রক্তবসন
পরিধান করতেন। সৃষ্টির প্রতীক হিসাবে শিবের
প্রতীক লিঙ্গ বা প্রজননের প্রতীক। এই প্রতীকের সাথে যোনি বা স্ত্রী সংযুক্ত হয়ে তিনি পূজিত হন।
শৈবমতে শিব মহাযোগী, সর্বত‍্যাগী। সন্ন্যাসী ও নির্গুণধ‍্যানের প্রতীক স্বরূপ।

আসলে কালনার একশো আট শিবমন্দিরের শুভ্রবর্ণের শিবগুলি ভগবান সদাশিবের প্রতীক।আর কৃষ্ণবর্ণের শিবগুলি রুদ্রের প্রতীক। প্রথম বৃত্তে ভক্ত পর্যায়ক্রমে ভগবান রুদ্র ও সদাশিবের মূর্তিতে ধরা দেন। পরিণামে ভক্ত বৈকুণ্ঠের অন্তর্গত তমোগুণ সম্বন্ধরহিত যে শিবলোক, সেখানে পৌঁছে যান এবং সর্বত্রই সদাশিবের মূর্তি প্রত্যক্ষ করেন।

এই শিবমন্দির প্রতিষ্ঠার সময় ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু ব্রাহ্মণ পন্ডিত অম্বিকায় এসেছিলেন বলে জানা যায়। তেজচন্দ্র তাঁদের পা
ধুইয়ে নতমস্তকে তাঁদের পদধূলি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সাতমহিষীর মধ্যে একমাত্র নানকীরাণীর গর্ভেই এক পুত্রসন্তান হয়। তাঁর নাম
প্রতাপচাঁদ। প্রতাপচাঁদের জন্ম ১৭৯২ খ্রীষ্টাব্দে আর এই একশো আট শিবমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে। সুতরাং এর থেকে অনুমেয় যে, পুত্রবাসনা সিদ্ধির জন্যই মহারাজ তেজচন্দ্র এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

এই মন্দিরের অন‍্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে একসাথে চারটির বেশি শিবলিঙ্গ দেখা যায় না। এই মন্দিরের প্রতিটি বৃত্তের দুটি করে দরজা। প্রথম বৃত্তের একটি উত্তর দিকে, একটি দক্ষিণ দিকে। ভেতরের বৃত্তের একটি পূর্বদিকে আর একটি পশ্চিম দিকে।

বারোজন ব্রাহ্মণ এই একশো আট মন্দিরের নিত‍্যপূজার দায়িত্বে ছিলেন। প্রতিজন ব্রাহ্মণ নয়টি করে শিব পুজো করতেন।

পুজোর উপাচার ছিল - 
চিনি ১/২ সের, ৪টি কলা, সুপুরি ৪ টি, পান ৯ টি, তেল ১ পোয়া, ঘি ১/২পোয়া, পাটালি ১ পোয়া ইত্যাদি প্রতিটি শিবের জন্য প্রতিদিন বরাদ্দ থাকত।

'নীলদর্পণে'র রচয়িতা দীনবন্ধু মিত্র তাঁর বিখ্যাত নাটকটির মূল উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন বর্ধমান জেলার অম্বিকা ও নদীয়ার শান্তিপুর অঞ্চল থেকে।

এই একশো আট শিবমন্দির সংখ্যায় অনেক বলে
অনেকেই খুব তাড়াতাড়ি করে এটিকে পরিদর্শন করেন। কিন্তু এই মন্দির তাড়াতাড়ি করে দেখলে এর গূঢ় তাৎপর্যকে উপলব্ধি করা যাবে না। আসলে শিল্পীরা তখন চিন্তা করেছিলেন, শুধু
বিগ্রহ নির্মাণ করলেই হবে না। সেই বিগ্রহে শাস্ত্রানুযায়ী প্রাণ প্রতিষ্ঠাও করতে হবে।

একশো আট শিবমন্দিরের গঠন আটচালা, চারচালার ওপর ক্ষুদ্রাকৃতি আর এক
চারচালা। উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট, প্রস্থ সাড়ে ৯ ফুট; প্রথম বৃত্তের ভেতর দিকে প্রায় ৭১০ এবং দ্বিতীয় বৃত্তের ভেতর দিকের পরিধি ৩৩০ ফুট।

একনজরে একশো আট শিবমন্দির দর্শন করা সৌভাগ্য। মানুষকে, বিশেষ করে ইতিহাস ও ধর্মাশ্রয়ী মানুষকে এই সুযোগ করে দিয়েছিলেন বর্ধমানের মহারাজ তেজচন্দ্র। এই মন্দিরের স্বর্ণমালা কালনা শহরের গাত্রকে সুসজ্জিত ও সৌন্দর্যসমৃদ্ধ করে তুলেছে।

আসলে, প্রত্যক্ষ জ্ঞান গভীর থেকে গভীরতর হলে তবেই সত‍্যর প্রকাশ পায়। আর সত‍্যর প্রকাশ পেলেই তা শিব অর্থাৎ মঙ্গল এবং মঙ্গল হলেই তা সুন্দর।

… 
তথ্যসূত্র :

১. কৌশিকী শারদীয় ১৩৯৫, পৃ: ১৫-২১
২. পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি (প্রথম খন্ড) - বিনয় ঘোষ
৩. বর্ধমান রাজ-আবদুল গনিখান ফার্মা কে এল এম
৪. অম্বুকন্ঠ, আশ্বিন ১৩৯৬ পৃথিবীর : ১১২-১৩
৫. কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত-বিবেকানন্দ দাশ
৬. তদৈব পৃ: ১৮৭
৭. কালনা শহরের কিছু প্রাজ্ঞ ব‍্যক্তিত্ব