ভ্রমণ কাহিনি | গুপ্তিপাড়ার গুপ্ত ইতিহাস ও ভোলা ময়রার জন্ম ভিটের সন্ধানে | সন্দীপ কুমার রাজ চক্রবর্তী | Haraf | Pralipta


জাপানি প্রবাদ আছে যে 'বাঁশের নল দিয়ে পুরো আকাশ দেখা যায় না।’
হ্যাঁ, সত্যি তাই।তাই জন্য বেরিয়েছিলাম ইতিহাস কে খোঁজার।অবশেষে ঠিক করলাম গুপ্তিপাড়ায় যাবো।একবার ঠিক করেছিলাম কিন্তু এর যাওয়া হয়নি।তাই যেতে তো হবেই কারণ ইতিহাস কে খুঁজতে গেলে স্পর্শ করতে হয়।তাই গুপ্তিপাড়ার গুপ্ত রহস্য খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম।কয়েকদিন একটু সময় করে গিন্নির সাথে কথা না বলে কয়েকটি বই র সাহায্যে অনেক কিছু জানালাম গুপ্তিপাড়া সম্বন্ধে।তাই তথ্য প্রযুক্তি কে হাতিয়ার করে বেরিয়ে পড়লাম।

‘ভ্রমণের মাধ্যমেই আমি প্রথম বাইরের দুনিয়া সম্পকে অবহিত হয়েছি এবং নিজেকে দুনিয়ার অংশ হিসেবে ভাবার পথ খুজে পেয়েছি।’ .....ইউডোরা ওয়েল্টি 

হাওড়া থেকে ৭৫ কিমি দূরত্বে ব্যান্ডেল-কাটোয়া লাইনে অবস্থিত গুপ্তিপাড়া। কাটোয়া লোকাল এ উঠে পড়লাম।হাওড়া থেকে ট্রেনে গুপ্তিপাড়া পৌঁছতে মোটামুটি দুই ঘণ্টার একটু কম সময় লাগে। হুগলি নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকা ঘিরেই গড়ে উঠেছে গুপ্তিপাড়ার জনবসতি। গুপ্তিপাড়া পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলী জেলার একটি প্রাচীন জনপদ। এই জায়গাটি চুঁচুড়া সদর মহকুমা ও বলাগড় থানার অধীন। গুপ্তিপাড়া ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত। ১৭৭৯ সালের রেনেলের মানচিত্রে দেখা যায় পার্শ্ববর্তী বেহুলা নদী গুপ্তিপাড়ার পাশ দিয়ে ভাগিরথী বা গঙ্গায় পড়েছে।
আয়তনে গুপ্তিপাড়া প্রায় ৭৩ হেক্টর বা ১৮০.৪৮ একর। ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুসারে এই গ্রামের জনসংখ্যা ছিল ৬৮৪ জন; অধিকাংশ বাসিন্দাই হিন্দু – জাতিতে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য। ২০১১ খ্রীষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুসারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে ৫৫৭ টি পরিবারে ২১৬৯ জন বসবাস করেন। সাক্ষরতার হারের দিক থেকে বিচার করলে গুপ্তিপাড়ার অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বেশ উচ্চ স্থানই অধিকার করে। ২০১১ খ্রীষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুসারে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে গড় সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৬.২৬%, সেখানে গুপ্তিপাড়ায় ৮৩.৯২ %। এখানে পুরুষের সাক্ষরতার হার ৮৭.২২ % ও মহিলাদের ৮০.৫৭ % । 
প্রাচীন গুপ্তিপাড়ার উল্লেখ ১৪৯৫ খ্রীষ্টাব্দে বিপ্রদাস পিপিলাই রচিত ‘মনসা মঙ্গল’ কাব্যে পাওয়া যায় – চাঁদ সওদাগরের ভাগীরথীর প্রবাহে চম্পকনগরী থেকে তরী ভাসিয়ে নদীপথে কাটোয়া, গুপ্তিপাড়া, ত্রিবেণী, সপ্তগ্রাম, ভাটপাড়া, মূলাজোর, গারুলিয়া, ইছাপুর, কাঁকিনাড়া, চানক (ব্যারাকপুর), খড়দহ, আড়িয়াদহ, চিত্রপুর বা চিৎপুর, কলিকাতা, কালীঘাট প্রভৃতি অঞ্চল অতিক্রম করে সাগর সঙ্গমে উপনীত হওয়ার বিবরণ বর্তমান।
পশ্চিমবাংলার সব থেকে উন্নতমানের ধানও পাওয়া যায় এই গুপ্তিপাড়া থেকেই। অন্যদিকে, ফলের রাজা আম বলতেই প্রথম যে জায়গাটার নাম মনে আসে তা মালদহ তারপর ই গুপ্তিপাড়ার হিমসাগর আমের জনপ্রিয়তা কোনো অংশে কম নয়।

ভ্রমণ স্থানগুলো:
১.শিশির বানী মন্দির পাঠাগার
২.চৈতন্য, বৃন্দাবনচন্দ্র, রামচন্দ্র এবং কৃষ্ণচন্দ্র।  এই চার মন্দিরের সমষ্টিকে বলা হয় গুপ্তিপাড়ার মঠ
৩.বনমঠের নিকট প্রাচীন দেশকালী মাতার মন্দির
৪.মোহনলালের স্মৃতিফলক, গুপ্তিপাড়া, হুগলী

প্রথমে আসি গুপ্তিপাড়া বলতে সবাই চেনে সেই বিখ্যাত ভোলা ময়রার জন্মভিটা।যদিও কোথায় তা জানা সম্ভব হয়নি।
স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেছেন "বাংলাদেশের সমাজকে সজীব রাখিবার জন্য মধ্যে মধ্যে রামগোপাল ঘোষের ন্যায় বক্তা, হুতুম প্যাঁচার ন্যায় লেখক ও ভোলা ময়রার ন্যায় কবিওয়ালার প্রাদুর্ভাব বড়ই আবশ্যক

বাগ ও বাজার‘‘সে ভোলানাথ নইরে আমি, সে ভোলানাথ নই।
আমি ময়রা ভোলা হরুর চেলা বাগবাজারে রই।’’

হ্যাঁ, সেই বাগবাজারের বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রা যে ফিরিঙ্গি কবিয়াল অ্যান্টনির চাপানের উতোরে বলেছিলেন। ওই ভোলা ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগের লোক।আবার অনেকের অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের লোক,সেই নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে আর আরো গবেষণার প্রয়োজন।

ভোলা ময়রা :

ভোলা ময়রা (১৯শ শতক)  কবিওয়ালা।কেউ কেউ বলেন তিনি আঠারো শতকের কবি, কারোর মতে তিনি আবার ঊনিশ শতকের। 
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জন্ম তারিখ জানা যায় নি।তাঁর প্রকৃত নাম ভোলানাথ মোদক; তবে এই নিয়ে অনেক তর্ক আছে।অনেক ঐতিহাসিকের মত পিতৃদত্ত নাম ভোলানাথ নায়েক৷ তত্‍কালীন বাংলার জনপ্রিয় কবিয়াল৷ পদবী নায়েক হলেও সম্ভবত পারিবারিক পেশার কারণেই নামকরণ হয়েছিল ‘ভোলা ময়রা’৷
কুলগত পেশা মোদক বা ময়রাবৃত্তি। পিতা কৃপারামের মিষ্টান্নের দোকান ছিল কলকাতার বাগবাজারে। বাগবাজারের পৈতৃক ডেরা ও ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেও ভোলানাথ বুঁদ হয়ে থাকতেন কবিগানের স্বপ্নে।
ভোলানাথ সামান্য শিক্ষালাভ করে পিতার দোকানে কাজ করতেন। ভোলানাথ গ্রাম্য পাঠশালায় লেখাপড়া শিখেছিলেন। পাঠশালায় লেখাপড়া শিখলেও সংস্কৃত, ফারসী ও হিন্দি ভাষায় তাঁর চলনসই জ্ঞান ছিল। পরে কবিয়ালরূপে খ্যাতি লাভ করলে তিনি ভোলা ময়রা নামে পরিচিত হন।ভোলা ময়রা বিবাহ করেন ত্রিবেণীতে। একটি কন্যা সন্তান, নাম কৈলাসী।
ভিন্নমত:
অনেক ঐতিহাসিক বলেন তার জন্ম বাগবাজারেই সম্ভবত।১৭৭৫ সালে তার জন্ম সম্ভবত।ক্রমে ক্রমে অর্থ উপার্জন করে কলিকাতার গ্রে স্ট্রীট এ তিনি বাড়ি করেন।অনেকে বলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের খুব কাছের লোক ছিলেন তিনি।

ভোলানাথের গুরু ছিলেন কবিয়াল  সিমলের হরু ঠাকুর। হরু ঠাকুর ছিলেন শোভাবাজার রাজবাড়ীর রাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের সভাসদ।ক্রমে গুরু শিষ্যের এমন এক সম্পর্ক দাঁড়িয়েছিল যে হরু ঠাকুর সব থেকে ভালো গান এবং সুর ভোলানাথকেই দিতেন। নবকৃষ্ণের মৃত্যুর পর হরু ঠাকুর যখন কবির দল তুলে দিয়েছিলেন তখন শিষ্যদের মধ্যে যারা নিজেদের যোগ্যতায় আস্থাশীল ছিলেন তাঁরাই নিজেদের কবিগানের দল গঠন করে নিয়েছিলেন।ভোলানাথ যখন দল করেন, প্রথম দিকে হরু ঠাকুর গান বেঁধে দিতেন।
তাঁর দলে দোহাররূপে ভোলানাথের  হাতেখড়ি হয়; পরে দল গঠন করে তিনি স্বাধীনভাবে  কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে  কবিগান পরিবেশন করেন। কবির লড়াইয়ে ভোলা ময়রা বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। রাম বসু, বলাই সরকার, যজ্ঞেশ্বর ধোপা,  এন্টনি ফিরিঙ্গি, হোসেন খাঁ প্রমুখ ছিলেন তাঁর প্রতিপক্ষ। উপস্থিতবুদ্ধি, চটুল ও আক্রমণাত্মক বাগ্ভঙ্গি, লঘু-গুরু বিষয়বস্ত্ত এবং সস্তা রস-রুচি দ্বারা তিনি শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারতেন। তিনি সাধারণত গুরু হরু ঠাকুর, গদাধর মুখোপাধ্যায়, ঠাকুরদাস চক্রবর্তী প্রমুখের রচিত গান গাইতেন।
বাংলার মিষ্টি শিল্পেরও সূচনা হয়েছিল এই গুপ্তিপাড়াতেই। ভোলা ময়রার জন্মস্থানের ব্যাপারটা সবাই একবাক্যে স্বীকার করলেও বিস্তারিত সঠিক তথ্য কেউই দিতে পারল না। কেউ বলতে পারলো না কোথায় জন্মস্থান।বরং গুপ্তিপাড়ার প্রাচীন ময়রাদের কাজ-কর্ম নিয়ে জানলাম অনেক মূল্যবান তথ্য। মাখা সন্দেশের প্রথম সূচনা এই গুপ্তিপাড়াতেই। আর সেই প্রাচীন মিশ্রণকে আকার দিয়ে নামকরণ করা হয় গুপো সন্দেশ। বলাহয় এটা নাকি ভোলা ময়রার কৃতিত্ব।গোঁফের নিচে স্ব-সম্মানেই জায়গা করে নিল গুপ্তপাড়ার গুপো সন্দেশ। 
গুপো সন্দেশ বা গুঁফো সন্দেশ পশ্চিমবঙ্গের একটি জনপ্রিয় মিষ্টি। এটি পাক করা ছানা থেকে প্রস্তুত দু'টি মন্ডকে হাত দিয়ে পাশাপাশি চেপে লাগানো এক জোড়া গোলাকৃতি সন্দেশ। এই জন্য একে জোড়া সন্দেশও বলা হয়। গুপো সন্দেশের বৈশিষ্ট্য হল যে এটি শুধুমাত্র গরুর দুধের ছানা থেকেই তৈরী হয়।গুপো সন্দেশের জন্মস্থান হুগলী জেলার সুপ্রাচীন জনপদ গুপ্তিপাড়া। গুপ্তিপাড়া ও পানিহাটির গুপো সন্দেশ ভীষণ জনপ্রিয়। খাদ্যরসিকদের কাছে গুপো সন্দেশই গুপ্তিপাড়ার প্রধান আকর্ষণ।গুপো সন্দেশকে বাংলার প্রথম ব্র্যান্ডেড মিষ্টি বলে মনে করা হয়।
ধর্মচর্চার পীঠস্থান হওয়ার জন্য গুপ্তিপাড়াকে 'গুপ্ত বৃন্দাবন' বলা হত। ক্রমে 'গুপ্ত বৃন্দাবন পল্লী', তার থেকে 'গুপ্ত পল্লী' এবং পরিশেষে গুপ্তিপাড়া নাম হয়।কথিত আছে যে গুপ্তিপাড়াতেই সন্দেশের জন্ম। এখানেই প্রথম তৈরী হয় সন্দেশের মিশ্রণ যা মাখা সন্দেশ নামে পরিচিত।পরে সেই মাখা সন্দেশকেই আকার দিয়ে তৈরী হয় গুপো সন্দেশ।কলকাতায় এই সন্দেশ জনপ্রিয় হলে তা 'গুপ্তিপাড়ার সন্দেশ' বা সংক্ষেপে 'গুপো সন্দেশ' বলে পরিচিতি লাভ করে। একটি মত অনুসারে লোকমুখে উচ্চারণে বিকৃতির ফলে গুপো সন্দেশ কালক্রমে 'গুঁফো সন্দেশ' নামে পরিচিত হয়েছে।অপর মতে সন্দেশটি খাওয়ার সময় গোঁফে লেগে যায় বলে তার নাম হয়েছে গুঁফো সন্দেশ।
ইতিহাস
গুপো সন্দেশের সৃষ্টিকর্তা বা জন্মসাল জানা যায় না। তবে ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে গুপো সন্দেশ প্রস্তুত হত, এমন তথ্য পাওয়া যায়। ১৮৫৪ সালে বাংলায় প্রথম রেলপথ হওয়ার আগে থেকেই গুপ্তিপাড়া থেকে নৌকা পথে সন্দেশ যেত কলকাতাসহ বাংলার বিভিন্ন স্থানে। গুপো সন্দেশ কালক্রমে কলকাতার অভিজাতদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়। উৎসবে অনুষ্ঠানে কলকাতার অভিজাতরা গুপ্তিপাড়ায় ছুটতেন গুপো সন্দেশ কিনতে।ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে পানিহাটির গুপো সন্দেশ কলকাতায় খুব জনপ্রিয় হয়।

প্রস্তুত প্রণালী

গুপো সন্দেশের মূল উপাদান গরুর দুধের ছানা, চিনি এবং খেজুর গুড়। গুপো সন্দেশে সাধারণত খেজুর গুড় ব্যবহার করা হয়। তাই প্রস্তুতকারকরা শীতকালে সারা বছরের জন্য খেজুর গুড় মজুত করে রাখেন।গুড়ের পরিবর্তে চিনিও ব্যবহার করা হয়। আদিতে মাখা সন্দেশ থেকে গুপো সন্দেশ তৈরী হলেও, বর্তমানে মাখা সন্দেশের থেকে গুপো সন্দেশের পাক অনেকটাই আলাদা। বিশাল কড়াইতে প্রথমে ছানা পাক দেওয়া হয়। তারপর সেই ছানা কাপড়ে মুড়ে তাতে কাঠ দিয়ে বারি মেরে মেরে অতিরিক্ত জল বের করে দেওয়া হয়। এরপর সেই ছানা হাতে পাক দিয়ে দু'টি করে সন্দেশ জুড়ে জুড়ে তৈরী হয় গুপো সন্দেশ।))

প্রাচীন সংস্কৃত শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে নানা টোল গড়ে উঠেছিল। সংস্কৃত ভাষার শিক্ষাবিদ, টোলের পন্ডিতেরা বসবাস কর‍তে থাকেন গুপ্তিপাড়ায়। এই সংক্রান্ত ভূর্জ পত্র বা তালপাতায় লেখা বহু প্রাচীন পুঁথি বহু স্থানীয় সরকারী গ্রন্থাগার 'শিশির বানী মন্দির পাঠাগারে' সংরক্ষিত আছে।
এরপর হাঁটা পথে রওনা দিলাম। জিজ্ঞেস করতে করতে পৌঁছে গেলাম মন্দির চত্বরে।আগে থেকে পরিকল্পনা ছিল কোথায় কোথায় যাবো যদিও।বাংলার স্থাপত্য শিল্পের অদ্ভূত নিদর্শন আজও বহন করে চলেছে গুপ্তিপাড়ার চার বৈষ্ণব মন্দির।
চৈতন্য, বৃন্দাবনচন্দ্র, রামচন্দ্র এবং কৃষ্ণচন্দ্র।  এই চার মন্দিরের সমষ্টিকে বলা হয় গুপ্তিপাড়ার মঠ।এই ৪ মন্দিরেরই নির্মাণকাল ভিন্ন। মধ্য ষোড়শ শতাব্দীতে বিশ্বর রায় কর্তক নির্মিত চৈতন্য মন্দিরটিই সর্বাধিক প্রাচীন। চৈতন্য মন্দিরের গায়ের টেরাকোটা শিল্প কালের নিয়মে আজ বিলুপ্তির পথে। ৬০ ফুট উচ্চতার বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরটিই অন্যান্য মন্দিরগুলোর তুলনায় আকারে ও উচ্চতায় সবচেয়ে বড়। ১৮১০ সালে নির্মিত এই মন্দিরে বাংলার ঐতিহ্যশালী টেরাকোটা শিল্প না থাকলেও বাইরের ও ভেতরের উভয় দেওয়ালেই আছে রং-বেরঙের ছবি আঁকা। বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরকে মাঝে রেখে দুই পাশে রয়েছে রামচন্দ্র মন্দির এবং কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শেওড়াফুলির রাজা হরিশচন্দ্র রায় নির্মাণ করেন একচালার রামচন্দ্র মন্দিরটি। এই মন্দিরের গায়ে অভূতপূর্ব টেরাকোটা শিল্পের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করা যায়। রামায়ণের নানা ঘটনা থেকে শুরু করে তৎকালীন যুগের দৈনন্দিন জীবনেরও বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি তুলে ধরা হয়েছে টেরাকোটার মাধ্যমে।
এছাড়া বৃন্দাবনমঠের নিকট প্রাচীন দেশকালী মাতার মন্দির আছে। দেশকালীমাতা গুপ্তিপাড়ার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কালীপূজার দিন নতুন মাটির মূর্তি এনে পুজো করা হয়। পরের শুক্লা দ্বিতীয়ার দিন মূর্তির কেশ, কাঁকন, কেউর, কপোল প্রভৃতি কেটে নিয়ে বাকি মূর্তি গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। খণ্ডিত অংশগুলো একটা আধারে রেখে সারা বছর তান্ত্রিক মতে পূজা করা হয়। এই মন্দিরে আধার ছাড়া কোনো দেবীমূর্তি নেই।
১৭৪৫ সালে নবাব আলিবর্দি খাঁ-র শাসনকালে তৈরি হয় কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরটি। এই মন্দিরটি আটচালাবিশিষ্ট। গুপ্তিপাড়ার ঐতিহ্য শুধু মন্দিরেই সীমাবদ্ধ নয়। বৈষ্ণব সংস্কৃতি প্রভাব গুপ্তিপাড়াতে ছড়িয়ে ছিল সেই সময় তা বোঝা যায়।
আবার এই মত ও আছে অনেক ঐতিহাসিরকের তথ্য অনুযায়ী যে গুপ্তিপাড়াতেই প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজোর প্রচলন হয়। ১৭৩০ সালে সেন রাজাদের বাড়ির দুর্গাপূজায় অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেন কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে ১২ জন মিলে একটি সংগঠন তৈরি করে  সূচনা করেন বারোয়ারি দুর্গাপূজার।এটি বিন্ধ্যবাসিনী জগদ্ধাত্রী পুজা নামে প্রচলিত। ১৭৬০ সালে (মতান্তরে ১৭৯০) নিজেরাই পুজা করার মনস্থির করেন। 
সঠিক প্রমাণ না থাকলেও অন্যান্য প্রামাণিক তথ্যাবলী থেকে বলা যায় যে ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে বলরাম বসু ঘাট রোডের ‘সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা’র উদ্যোগে আয়োজিত পুজোই কলকাতার প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো।
গুপ্তিপাড়ার প্রধান ও বিখ্যাত উৎসব হল দোল ও রথযাত্রা। ২৭৯ বছরের প্রাচীন বৃন্দাবনচন্দ্রের রথযাত্রা শুরু হয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে, গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা বাংলার রথযাত্রা গুলোর মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত রথ যাত্রা। নানা মতভেদ থাকলেও ১৭৪০ সালে এই রথ উত্‍সব শুরু করেন মধুসুদানন্দ।ভান্ডার লুট গুপ্তিপাড়ার রথের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। পুরীর রথের সঙ্গে গুপ্তিপাড়ার রথের পার্থক্য হল, পুরীর রথকে জগন্নাথ দেবের রথ বলে। আর গুপ্তিপাড়ার রথকে বলে বৃন্দাবন জীউর রথ। গুপ্তিপাড়ার রথের বৈশিষ্ঠ হল, উল্টো রথের দিন এখানে ভান্ডার লুট হয়। ভারতবর্ষের কোথাও এই ভান্ডার লুট হয়না।
(ভান্ডার লুট
অন্য জায়গায় মতন এই দিন জগন্নাথ দেব তার মাসির বাড়িতে সকল মানুষের অন্তরালে বন্ধ ঘরে থাকেন। এই দিন জগন্নাথ দেবকে অনবদ্য নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়। জগন্নাথের মাসির বাড়িতে ৫২টি লোভনীয় পদে প্রায় ৪০ কুইন্টাল খাবারের 'ভাণ্ডার লুট পালন হয়।

প্রেক্ষাপট  
কথিত আছে লক্ষ্মীর সঙ্গে মন কষাকষি হওয়ায় জগন্নাথ লুকিয়ে মাটিতে এসে আশ্রয় নেয়। সেখানে ভাল ভাল খাবার পেয়ে জগন্নাথ মাসির বাড়িতেই থেকে যান। অন্যদিকে লক্ষ্মীর মনে সন্দেহ দানা বাঁধে যে স্বামী বোধহয় পরকীয়ার টানে কোথাও চলে গিয়েছেন। পরে তিনি বৃন্দাবনের কাছে জানতে পারেন যে জগন্নাথ মাসির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তারপরেই স্বামীকে ফিরিয়ে আনতে লক্ষ্মী লুকিয়ে গিয়ে মাসির বাড়িতে সর্ষে পােড়া ছিটিয়ে আছে। কিন্তু, তাতে কোনো কাজ না হওয়ায় বৃন্দাবন ও কৃষ্ণচন্দ্র লোকজন নিয়ে মাসির বাড়িতে হাজির হন।
সেখানে গিয়ে তারা দেখেন যে ঘরের তিনটি দরজা বন্ধ। তাই লক্ষ্মীর অনুরোধে তার স্বামীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরজা ভেঙে বৃন্দাবন ও কৃষ্ণচন্দ্র ভেতরে ঢােকেন। ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেই তারা দেখতে পান মালসায় করে রকমারি পদের খাবার সাজানাে রয়েছে। ভাল ভাল খাবার চোখের সামনে দেখে তারা সেই সমস্ত মালসা লুট করে নেন। যা ভাণ্ডার লুট নামে সকলের কাছে পরিচিত।
আবার আরেকটি অংশ দাবি, বৃন্দাবন চন্দ্র প্রচুর ধনসম্পত্তি ছিল। রাজা তার রাজ্যের শক্তিমানদের চিহ্নিত করার জন্য এই ভান্ডার লুটের আয়োজন করেছেন। যারা বেশি সংখ্যায় ভাণ্ডার লুট করে তাদের বৃন্দাবন চন্দ্র তার মন্দির পাহারার দায়িত্বে নিয়ােগ করতেন।
তবে প্রথা চালুর কারণ নিয়ে দ্বিমত থাকলেও প্রাচীন সেই রীতি মেনে এখনও প্রতিবছর উল্টোরথের আগের দিন মাসির বাড়ির মন্দিরের তিনটি দরজা একসঙ্গে খেলা হয়। ঘরের ভিতর রকমারি খাবারের পদ মালসায় করে সাজানো থাকে। দরজা খেলার পর এই প্রসাদ নেওয়ার জন্য মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। এই মালসা ভোগ পাওয়ার জন্য দূরদূরান্ত করে কয়েক হাজার মানুষ উল্টোরথের আগের দিন প্রসাদ পাওয়ার জন্য গুপ্তিপাড়া হাজির হন।

ভোগ
ভান্ডার লুটের জন্য গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, কুমড়ো ভাজা, ছানার রসা, পায়েস, ক্ষীর, ফ্রায়েড রাইস, মালপোয়া, সন্দেশ, ও রাবড়ি সহ মোট ৫২টি পদে খাবার সহ প্রায় ৫৫০ টি মালসা তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিটি মালসা প্রায় ৫ থেকে ৮ কেজি করে খাবার থাকে।
এই কর্ম যজ্ঞের জন্য ১০ জন রাঁধুনি ও ১০ জন হেল্পার সহ মােট ২০ জন রান্নার কাজ করেন। নিয়ম মেনে দুপুর দুটোর আগেই সমস্ত খাবার তৈরি করে মালসায় সাজিয়ে মাসির বাড়িতে রাখা হয়। বিকেল ৩ টায় মাসির বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়।))
পূর্বভারতের নানা অঞ্চল থেকে রথের রশি টানার জন্যে মানুষ আসেন।

এরপর আসি মহানলালের স্মৃতিফলক নিয়ে।মোহনলাল ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার অন্যতম সেনাপতি। পলাশীর যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও সিরাজের পক্ষে বিশ্বস্ততার সাথে লড়াইয়ের কারণে তিনি পরিচিত।
প্রথম জীবন

মোহনলাল ছিলেন নবাব সিরাজদ্দৌলার একজন অন্যতম বিশ্বস্ত কর্মকর্তা। তিনি দেওয়ান মোহনলাল নামে পরিচিত ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি জাতিতে কাশ্মিরি ছিলেন এবং হিন্দু কায়স্থ পরিবারের সন্তান ছিলেন।১৭৫৬ সালের এপ্রিলে নবাবের আসনে বসেই সিরাজদ্দৌলা যে দুজন দক্ষ কর্মকর্তার ওপর আস্থা স্থাপন করেছিলেন তারা হলেন মীর মদন ও মোহনলাল। নবাবের দেওয়ানখানার পেশকার নিযুক্ত করে তাকে মহারাজা উপাধি ও মনসবদারী দান করা হয়। তাকে বিহারের পূর্ণিয়ার শাসনভারও অর্পণ করেন নবাব। নবাব দরবারে তার প্রতিপত্তিতে সিরাজের শত্রুরা আতঙ্কিত হয় এবং মোহনলালকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চক্রান্তও হয়েছিল একথা নবাব দরবারে আগত ফরাসি দূত মঁসিয়ে ল' তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন।

পলাশীর যুদ্ধ

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের সময় মোহনলাল সিরাজের প্রতি অবিচল বিশ্বস্ততায় যুদ্ধ করেছিলেন। গোলাম হোসেন রচিত 'সয়ার-উল-মুতাখেরিন' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মীর মদনের মৃত্যুর পরেও মোহনলালের একক চেষ্টায় যুদ্ধের গতি সিরাজের অনুকূলে ছিল।কিন্তু নিজ অদূরদর্শিতা ও মানসিক দুর্বলতাহেতু তরুণ নবাব সিরাজ মীর জাফর প্রমুখ বিশ্বাসঘাতকদের প্রভাবে যুদ্ধ বন্ধ রাখার আদেশ দেন। ফলত: নবাব বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও শোচনীয় পরাজয় ঘটে। মোহনলালের যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটে এমনটা অনেকে মনে করেন। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মতে মোহনলাল যুদ্ধে আহত হন। যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে তার বড় ছেলে (পূর্নিয়ার নায়েব নাজিম) শ্রীমন্ত লাল মিরনের হাতে মারা যান। ছোট ছেলে হুক্কা লাল পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন।

নিখোঁজ জীবন ও বিতর্ক

মোহনলালের পলাতক জীবন সম্পর্কে বিশেষ বিতর্ক আছে। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় ও সোনিয়া আমিন বলেন, মোহনলালের ভগ্নী ছিলেন সিরাজের প্রণয়িনী এবং তিনি তাদের শিশুপুত্রকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে ময়মনসিংহে আশ্রয় নেন। তারপর তার অজ্ঞাতবাস পর্বের নানা কিংবদন্তী ছড়িয়ে আছে বাংলায়। অনেক ঐতিহাসিক অনুমান করেন তার জন্মস্থান হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়া, সেখানে বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরে তিনি আত্মগোপন করে থাকেন যুদ্ধোত্তর পর্বে। নদীয়ার কালীগঞ্জের নিকটবর্তী জুড়ানপুর শাক্তপীঠেও তার অবস্থানের কাহিনী প্রচলিত আছে কিংবদন্তি মোতাবেক.

গুপ্তিপাড়ায় রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গীত শিক্ষাগুরু ‘কালী মির্জা’ গুপ্তিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কোথায় তার জন্মভিটা সেটা জানা যায় নি।‘কালী মির্জা’র পিতৃদত্ত নাম কালীদাস মুখোপাধ্যায়। সংস্কৃত ব্যতীত ফার্সি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শিতা, ইসলাম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা ও ইসলাম ধর্মাবিলম্বীগণের ন্যায় পরিধান ব্যবহারের জন্য তিনি ‘মির্জা’ নামে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। কিছুদিনের জন্য বর্ধমানে রাজা প্রতাপ চাঁদ’এর সঙ্গীত সভার আসনও অলংকৃত করেন। ‘কালী মির্জা’র প্রধানতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহন ঠাকুর যিনি নিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু ‘টপ্পা’ গানের সঙ্গে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মেলবন্ধন ঘটান; নিধুবাবুও এই অঞ্চলেরই মানুষ। গীতিকার, সুরকার ‘কালী মির্জা’ রচিত ও সুরারোপিত বিভিন্ন প্রকারের সঙ্গীত প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করে। কালী,রাধা,কৃষ্ণ প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে প্রেম ও ভক্তি রসাত্মক বহু সঙ্গীত সৃষ্টির মাধ্যমে ‘কালী মির্জা’এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন।

এছাড়া বিখ্যাত বিজ্ঞানী ইন্দুমাধব মল্লিক  জন্মস্থান হিসেবেও স্বীকৃত।
ভোলা ময়রা ও কবিয়াল গানের ইতিহাস নিয়ে এখনও অনেক তথ্য অজানা।অনেক গবেষণার প্রয়োজন আছে।ভোলা ময়রা এমন এক ব্যক্তিত্ব যাকে আমরা ভুলতে পারবো না।আর গুপ্তিপাড়ার ইতিহাস নিয়ে আরো খোঁজ করছি যদি কিছু সন্ধান পাই আবার নিয়ে এসব নতুন তথ্য নিয়ে।অবশেষে একটাই কথা মনে আসে ....
‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই
পাইলেও পাইতে পারো, অমূল্য রতন’
সত্যি অনেক কিছু স্মৃতি ও অনেক তথ্য নিয়ে গেলাম গুপ্তিপাড়া থেকে।সেন্ট অগাস্টিনের কথা মনে পড়ে গেল.....
পৃথিবী একটা বই আর যারা ভ্রমণ করে না তারা বইটি পড়তে পারে না।’ 
-সেন্ট অগাস্টিন
অবশেষে ফেরার পালা। ইবন বতুতার কথা