চাপানো পুজোর ছোট্ট ইতিহাস - Pralipta


মানস শেঠ: অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝা মাঝি সময় থেকে উনিশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ছিল কলকাতার শ্রেষ্ঠতম সামাজিক উৎসব বাংলার  দুর্গোৎসব।রাজা প্রজা নির্বিশেষে যোগ দিত।তখনকার সব জায়গায় প্রতিমা না হলেও ঘট-পট-শালগ্রাম শিলার।কিন্তু ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির সময় কিন্তু হঠাৎ-বাবু হয়ে ওঠা ধনশালীরা প্রচুর টাকা খরচ করে দুর্গাপুজো করতেন।এই পৌত্তলিকদের পুজো রাতারাতি পরিণত হলো কোম্পানির পুজোয়।কোম্পানির সেনাপতি তখন লর্ড ক্লাইভ অর্থাৎ দেশের রাজা।হিন্দুদের যাবতীয় ধর্মাচারের পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠলেন ইংরেজরা।

       নেটিভদের পুজোয় আনন্দভোজে যোগদান,মঠ-মন্দিরের তদারকি এবং দেবতাদের সম্মানরক্ষার জন্য কামান দাগা সবই করতেন।তাই আনন্দ-উল্লাস টা বেশি ছিল সাহেব-সুবোদের।সাহেবরা আমন্ত্রণ পত্র ত পেতেনই,যাঁদের সঙ্গে পরিচয় বা ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল না তাঁদের জন্য ছাপা হত উদার এবং আকর্ষক বিজ্ঞাপন।কারণ,বাবুরা জানতেন উপলক্ষ দুর্গাপুজো হলেও, উৎসব করবে কোম্পানি আর বাবুদের উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির অনুগ্রহ লাভ।

       সাহেবদের ঘিরে এই দুর্গোৎসবের ঐতিহ্য এবং সমারোহ কিন্তু বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি কলকাতা।পুজোর মন্দার খবরটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮২৯ সালের সরকারি গ্যাজেটে,লেখা হল,

"পূর্বে দুর্গোৎসবে যেরূপ সমারোহ নৃত্য গীতাদি হইত এক্ষণে বৎসর ২ ক্রমে ঐ সমারোহ ইত্যাদি হ্রাস হইয়া আসিতেছে।"

  এবং পুজোর আড়ম্বর কমতে কমতে গোটা তিন পড়ন্ত বাড়ির দালানে এসে ঠেকেছিল।"সমাচার চন্দ্রিকা"লিখতে বাধ্য হলো,

"শ্রী শ্রী পূজার সময়ে যে প্রকার ঘটা কলিকাতায় হইত এক্ষণে তাহার ন্যূন হইয়াছে কেননা ঁগোপীমোহন ঠাকুর ও মহারাজা সুখময় রায়বাহাদুর ও বাবু নিমাইচরণ মল্লিক প্রভৃতির বাটির সম্মুখ রাস্তায় প্রায় পূজার তিন রাত্রিতে পদব্রজে লোকের গমনাগমন ভার ছিল যেহেতুক ইঙ্গরেজ প্রভৃতির লোকের শকটাদির ও যানবাহনের বাহুল্যে পথরোধ হইত।"

     দুর্গাপুজোর অবস্থা যে সময় এমন পড়তির দিকে তখন নদীয়া,নাটোর বর্ধমান রাজের অধীনে অর্থাভাবে পুজোয় অপারগ বাবুদের ডেকে দুর্গোৎসবের আজ্ঞা দিতেন।এমনকি যারা নিলামে জমিদারি হারিয়ে নিঃস্ব হতেন তাঁরাও অন্য সম্পন্ন জমিদারের কাছে দেবীপুজোর সাহায্য চাইলে, তাঁরা অর্থ ও ভুমিবৃত্তি দিয়ে পুজোর ব্যবস্থা করতেন।কিন্তু তবু শারদীয়া রোধ করা গেল না।

   কারণ,হিন্দুদের উৎসবে খ্রিস্টানদের যোগদান উচিত কিনা এই নিয়ে একশ্রেণীর গোঁড়া হিন্দু আর খ্রিস্টানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল।রেভারেন্ড পেগ নামে এক পাদ্রি সাহেব হিন্দুদের পুজোতে খ্রিস্টানদের মাতামাতি দেখে স্বদেশে গিয়ে আন্দোলন শুরু করলেন।১৮৪০ সালে"দশ নম্বরী"নামে এক বিশেষ আইন জারি করে ইংরেজদের হিন্দু-মন্দিরের পোষকতা, হিন্দুদের উৎসবে অংশ গ্রহন ও তোপ-দাগানো বন্ধ ক'রে দিলেন।সুতরাং যে-পুজোর প্রধান আকর্ষণ ছিল কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতা, সেই কোম্পানি যখন হাত তুলে দিল তখন অনিবার্য ভাবেই এলো মন্দা।অনেকে পুজো করাই বন্ধ করে দিলেন।এই প্রসঙ্গে ১৮৩২ সালের ১৩ ই অক্টোবরের 'জ্ঞানান্বেষণ'পত্রিকা লেখে কুমোরটুলির শিল্পীরা লোকসান করতে থাকে,বিক্রি না হওয়া প্রতিমা আবার শিল্পীর বাড়িতে পরে থাকলে অধর্মের কাজ।

      দুর্গাপুজোর মন্দার বাড়িতে অন্যের বাড়িতে দুর্গামূর্তি ফেলাটাও হয়ে দাঁড়াল একটা সংক্রামক ব্যাধির মত।তাই ১৮৩২ সালে এক নতুন ধরণের পুজোর উদ্ভব হলো তার নাম "চাপানো পুজো"।পাড়ার ছেলেরা কুমোরটুলিতে পড়ে থাকা প্রতিমাগুলো নিয়ে কয়েকটি গৃহীর গৃহে ফেলে দিল।দায়ে পড়ে মানুষ পুজো করতে লাগল।অনেকে সোনাদানা বিক্রি করেও পুজো করতেন।কেউ পুজো না করেই প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে দিতেন,কিন্তু সরস্বতী মূর্তিটি রেখে দিতেন শ্রীপঞ্চমীর দিন পুজো করবেন বলে।যারা ধনী অথচ কৃপণ তারা ফেলে যাওয়া দুর্গা কে গোপনে লুকিয়ে ফেলতেন।

    উনিশ শতাব্দীতে অন্যের বাড়িতে মূর্তি ফেলার ব্যপারটা এত বেশি সংক্রামিত হয়ে গেল যে তা নিয়ে শুরু হলো অশান্তি। ১২২৭ সনের ৬ ই আশ্বিন সকালে বেলঘড়িয়ার এক ভদ্রলোক তাঁর বাড়ির সামনে দেখলেন এক দো-মেটে দুর্গা প্রতিমা।তিনি রেগেমেগে মূর্তিটি ভেঙে দিলেন।কেউ বললেন, উচিত কাজ আবার কেউ বা বললেন মহাপাতকের কাজ।বেঁধে গেল খন্ডযুদ্ধ।মূর্তি যারা ফেলত তাদের সঙ্গেও অনেক সময় গৃহকর্তাদের দ্বন্দ্ব বেঁধে যেত।এসব ঘটনা হিন্দু শিরোমনিদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠল।বিভিন্ন ধর্মসভা কিছু সিদ্ধান্তে এলেন,

১.কৃপণ ব্যক্তিদের খরচ করাবার উদ্দেশ্যে

২.কলকাতার যেসব নববাবু মোসাহেব সহ আপনজনদের নিয়ে ফুর্তি করে অর্থের অপচয় করতেন।

৩.সামর্থ্য থাকা সত্বেও যারা বারোয়ারি পুজোর চাঁদা দিতেন না।

৪.বিদ্বেষবশত নিরীহ গরীব মানুষদের জব্দ করতে।

৫.ঈর্ষান্বিত হয়ে অপছন্দের মানুষকে অর্থদন্ড করাত।

    সেকালের সংবাদপত্র ঘাঁটলেও মূর্তি ফেলার সপক্ষে বিপক্ষে কলম চলেছে।১৮৩৩ সালের ১২ ই অক্টোবর "সমাচার দর্পন"মন্তব্য করে লিখলো,-

 "...অধিক রাত্রিযোগে গৃহস্থ লোকেরদের দ্বারে ২ দেবপ্রতিমা বিশেষত দুর্গা প্রতিমা ফেলিয়া দেওনের অতি কদর্য ব্যবহার দিন ২ বর্ধিষ্ণু হইতেছে।...কথন ২ অতি পরিমিত ব্যয়ী সদ্বিবেচক যিনি স্বীয় গোত্র বুঝিয়া সাধারণ কর্মে ব্যয় করেন,ইদৃশ ব্যক্তির উপরও কতকগুলো পাগল বালকেরা এইরূপ ভার দিয়া ক্লেশ দেয়।"

 "সমাচার চন্দ্রিকা"ছিল রক্ষণশীলদের কাগজ এবং পুজোর প্রচারক।তাই 'সমাচার দর্পন'এর প্রতিবেদন দেখে রুষ্ট হয়ে লিখল,

"বাটিতে প্রতিমা রাখিয়া গেলে তাহাতে যদি কাহার ক্ষতিবোধ হয় সে বড় ৫০/৬০ টাকাই ক্ষতি হউক কিন্তু ইহকাল পরকাল ভালো হয়।...প্রতিমা পূজা করিয়া কেহ একেবারে কাঙ্গাল হইয়াছে এমত কখন শুনা যায় নাই।অতএব দর্পনকার মহাশয় এ বিষয় রহিত করিবার কোন চেষ্টা করা বিফল ইহাতে হাত দিলে হাস‍্যস্পদের নিমিত্ত হইবেন।"

  বলা বাহুল্য 'সমাচার চন্দ্রিকা'পত্র ও রক্ষণশীল হিন্দু সম্প্রদায় লোকের বাড়ির দরজায় মূর্তি ফেলাকে গৃহস্থের পরম কল্যাণকর ধর্মীয় অনুষ্ঠান ব'লে সমর্থন ও প্রচার করতে চাইলেও এই কু-প্রথা কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।এই জোর করে 'চাপানো-পুজো'শেষ পর্যন্ত বর্জন করেছিল বাংলার মানুষ।